Wednesday, October 26, 2011

ইতিহাসের নৃশংসতম বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানীসহ ঘাতক চক্রের ভূমিকা: (দ্বিতীয় পর্ব)



ইতিহাসের নৃশংসতম বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানীসহ ঘাতক চক্রের ভূমিকা:

http://blog.bdnews24.com/dr_mushfique

(দ্বিতীয় পর্ব)

মুশফিক ইমতিয়াজ চৌধুরী

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫-এর ঘটনায় নিহতদের অবস্থা ও দাফন-কাফন:
১৯৭৫-এর ১৬ আগস্ট রাত তিনটায় ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডারের আদেশে আমি প্রয়াত শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি যাই। স্টেশন কমান্ডার আগেই পৌঁছে গিয়েছিলেন। মেজর বজলুল হুদা ও তাঁর লোকজন পাহারা দিচ্ছিলেন বাড়িটি। হুদা আমাকে প্রথমে বাধা দিলেও পরে ঢোকার অনুমতি দেন।

এক. সড়ক নম্বর ৩২, শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি: সবগুলো লাশ সিঁড়ির গোড়ায় আনা হলো। রাখা হলো কাঠের কফিনে। বরফ আনা হয়েছিল। রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল প্রথম তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে। বাড়ির সব বাসিন্দাকেই খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে যায়। খোসাগুলো মেঝেতে পড়া ছিল। কয়েকটি জানালার কাচ ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র, গিফটবক্স ও সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিয়েগুলোর উপহারের প্যাকেট। পবিত্র কোরআন শরিফও মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখলাম।

ক. শেখ মুজিবের বাড়িতে নয়জনকে হত্যা করা হয়েছিল। লাশগুলো (প্রদত্ত রিপোর্ট মতে) যে অবস্থায় পাওয়া যায়:
১. শেখ মুজিব: প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানটায় যে সমতল অংশটি তার তিন-চার ধাপ ওপরে। চশমার ভাঙা কাচ ও একটি পাইপ সিঁড়িতে পড়ে ছিল।
২. শেখ কামাল: অভ্যর্থনা কক্ষে
৩. টেলিফোন অপারেটর: অভ্যর্থনা কক্ষে
৪. শেখ নাসের: নিচতলার সিঁড়িসংলগ্ন বাথরুমে
৫. বেগম মুজিব: মূল বেডরুমের সামনে
৬. সুলতানা কামাল: মূল বেডরুমে
৭. শেখ জামাল: মূল বেডরুমে
৮. রোজী জামাল: মূল বেডরুমে
৯. শিশু রাসেল: মূল বেডরুমে, তার দুই ভাবির মাঝখানে

দুই. বাড়ির সব বাসিন্দাকেই খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। দেখে মনে হচ্ছিল, তাঁদের সবাই তাত্ক্ষণিকভাবে প্রাণ হারান।

শেখ মুজিব: প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে যে সমতল জায়গাটা তার তিন-চার ধাপ ওপরে একেবারে কাছ থেকে গুলি করে শেখ মুজিবকে খুন করা হয়। তাঁর তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁজরা। শেখ মুজিব সব সময় চশমা পরতেন এবং তাঁর ধূমপানের অভ্যাস ছিল। তাঁর চশমা ও তামাকের পাইপটি সিঁড়িতে পড়া ছিল। পরনে চেক লুঙ্গি ও পাঞ্জাবি। চশমার একটি গ্লাস ভাঙা। রক্তে পাঞ্জাবির রং ছিল গাঢ় লাল। একটি বুলেট তাঁর ডান হাতের তর্জনীতে গিয়ে লাগে এবং আঙুলটি প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

শেখ কামাল: কামালের বুক ও তলপেটে তিন থেকে চারটি বুলেট বিদ্ধ হয়। তাঁর পরনে ছিল ট্রাউজার। নিচতলায় তাঁকে খুন করা হয়।
টেলিফোন অপারেটর: তাঁকে নিচতলায় খুন করা হয়।

শেখ নাসের: শেখ নাসেরকে খুন করা হয় বাথরুমের কাছে। তাঁর হাত উড়ে গিয়েছিল। গুলিতে তাঁর দেহের বেশ কিছু স্থান ছিল ক্ষতবিক্ষত। তাঁর গায়ে কোনো পোশাক ছিল না। এবং লাশ বিছানার চাদরে মোড়ানো ছিল।

বেগম মুজিব: বেগম মুজিবকে বুকে ও মুখমণ্ডলে গুলি করা হয়। তাঁর পরনে ছিল সুতি শাড়ি এবং কালো রঙের ব্লাউজ। গলায় মাদুলি বাঁধা একটি সোনার নেকলেস। কনিষ্ঠা আঙুলে ছোট্ট একটি আংটি। তখনো তাঁর পায়ে ছিল একটি বাথরুম স্লিপার!

সুলতানা কামাল: সুলতানা কামালের বুক ও তলপেটে গুলি লাগে। পরনে ছিল শাড়ি ও ব্লাউজ।

শেখ জামাল: শেখ জামালের মাথা চিবুকের নিচ থেকে উড়ে গিয়েছিল। পরনে ট্রাউজার। ডান হাতের মধ্যমায় ছিল একটি মুক্তার আংটি। সম্ভবত এটি ছিল তাঁর বিয়ের আংটি।

রোজী জামাল: তাঁর মুখটি দেখাচ্ছিল বিবর্ণ, মলিন। মাথার একাংশ উড়ে গিয়েছিল। তাঁর তলপেট, বুক ও মাথায় গুলি করা হয়। পরনে ছিল শাড়ি ও ব্লাউজ।

শিশু রাসেল: সম্ভবত আগুনে তার পা ঝলসে যায়। মাথা উড়ে গিয়েছিল। পরনে ছিল হাফপ্যান্ট। লাশ একটি লুঙ্গিতে মোড়ানো ছিল।

তিন. মেঝেতে ছড়ানো-ছিটানো ছিল সম্প্রতি অনুষ্ঠিত জামাল ও কামালের বিয়ের অনেক উপহারসামগ্রী এবং গিফট প্যাকেট। কিছু বাক্স ছিল ফাঁকা। কামালের কক্ষে রুপার তৈরি অনেক জিনিসপত্র দেখা যায়। সিঁড়িতে ছিল আল্পনা আঁকা। অভ্যর্থনা কক্ষটি ছিল নোংরা। আমি ওপরতলা থেকে শুনলাম নিচতলায় হুদা চিত্কার করছেন। তিনি এ বাড়ি থেকে কিছু জিনিসপত্র চুরি করায় কয়েকজন সিপাহিকে গালাগাল দিচ্ছিলেন।

চার. সড়ক নম্বর ১৩/১, ধানমন্ডি, শেখ মণির বাড়ি: মণি ও তাঁর সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে তাঁদের এই বাড়িতে খুন করা হয়। তাঁদের বাড়ির দিকে সেনাবাহিনীর গাড়িআসতে দেখে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা দায়িত্ব ছেড়ে সরে যান। বাড়িটি ছিল আংশিক তছনছ করা। মেঝেতে স্পষ্ট রক্তের দাগ। মাঝের টেবিলে একটি অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে কিছু ভিজানো চিঁড়া।

পাঁচ. ৩৭ মিন্টো রোড, আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ি: মন্ত্রীর বাড়িটি ছিল ফাঁকা। ড্রয়িং রুমজুড়ে দেখা গেল জমাট বাঁধা রক্ত। বাড়ির নিরাপত্তা পুলিশ আগেই পালিয়ে গিয়েছিল!

ছয়. সেরনিয়াবাত ও শেখ মণি এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যদের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে সংগ্রহ করা হয়। লাশগুলো ছিল বিকৃত। তাপ ও আর্দ্রতা লাশের ক্ষতি করে। লাশ থেকে দুর্গন্ধ বেরোচ্ছিল। বনানী গোরস্থানে দাফনের জন্য আমরা লাশগুলো সেনানিবাসে নিয়ে এলাম। শেখ মুজিবের লাশ ছাড়া ৩২ নম্বর সড়কের অন্য সবার লাশও আরেকটি ট্রাকে করে সেখানে আনা হয়।

দাফন-কাফন সম্পর্কে প্রতিবেদন

১. মৃতদেহ সংগ্রহ: ১৫ আগস্ট ঘটনায় নিহতদের লাশ ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়ক এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গ থেকে সংগ্রহ করা হয়। দুটি ট্রাকে করে ১৮টি লাশ দাফনের জন্য আনা হয়। বনানী গোরস্থানে দাফনের জন্য গুলশান মিউনিসিপ্যালিটি থেকে অনুমতি নেওয়া হয়। এএসসি (আর্মি সার্ভিসেস কোর) সিপাহিদের একটি প্লাটুন গোরখোদকের কাজ করে। স্টেশন কমান্ডার আগেই আমাকে বলেছিলেন, ১৬ আগস্টের দিনের প্রথম আলো ফোটার আগেই যাতে দাফনের সব কাজ শেষ হয়ে যায়!

২. দাফন: আগস্ট মাসের তাপ ও আর্দ্রতায় কিছু লাশ বিকৃত হয়ে গিয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে কোনো ফ্যান ছিল না। ৩২ নম্বরের লাশগুলোতে বরফ দেওয়া ছিল। ফলে সেগুলোর অবস্থা ছিল অপেক্ষাকৃত ভালো। সিপাহিদের কয়েকজন ছিল, খুবই গলা চড়িয়ে কথা বলছিল। শেখ মুজিববিরোধী মনোভাব প্রকাশ করছিল তারা। ফলে আমাকে গোটা পরিস্থিতিই সতর্কতার সঙ্গে সামাল দিতে হয়। অবশ্য কোনো লাশেরই যাতে অমর্যাদা না হয় আমি সেটি নিশ্চিত করেছিলাম। সিপাহিদের কয়েকজন কবর খুঁড়তে অনীহা প্রকাশ করে, লাশের খারাপ অবস্থার কারণে কয়েকজন এমনকি ছুঁতে পর্যন্ত রাজি ছিল না। আমি নিজে প্রথম মৃতদেহটি (বেগম মুজিবের) ওঠাই এবং চিরশয্যায় শায়িত করি। শেখ নাসেরের দেবাবশেষ একইভাবে দাফন করি। এরপর আর আমার সমস্যা হয়নি। চার নম্বর ছাড়া বাকি প্রায় সবগুলো কবর ঠিকভাবে খোঁড়া হয়। কারণ আমরা সূর্যোদয়ের আগেই সব সেরে ফেলার জন্য তাড়াহুড়ো করছিলাম। গোরস্থানমুখী সড়কগুলোয় আমরা আগেই সিপাহি মোতায়েন এবং গোরস্থান এলাকায় কারফিউজারি করি। ভোরে ঘুম ভাঙা কিছু লোক ও পথচারী কী ঘটছে বোঝার চেষ্টা করলে তাদের নিরুত্সাহিত করা হয়।

৩. সাত নম্বর সারির চারপাশে বেড়া দেওয়া হয় এবং অস্থায়ী চৌকি বসিয়ে ২৪ ঘণ্টা পাহারার ব্যবস্থা করা হয়। অনির্দিষ্টকালের জন্য গোরস্থানটিতে দাফন কাজ বন্ধ ও দর্শনার্থীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়।

৪. মৃতদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র: কয়েকটি লাশের সঙ্গে কিছু গয়না পাওয়া যায়। একটি তালিকা তৈরি করে গয়নাগুলো স্টেশন কমান্ডারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

৫. শেখ মুজিবের দাফন: ১৬ আগস্ট, ১৯৭৫ বেলা ১১টায় শেখ মুজিবের লাশ সেনাবাহিনীর একটি ট্রাকে করে ক্যান্টনমেন্টে আনা হয়। কাফন কেনা হয় সিএসডি (ক্যান্টিন স্টোরস ডিপার্টমেন্ট) থেকে। এটি কেনা হয়েছিল বাকিতে! অর্ডন্যান্সের জিডিও (গ্যারিসন ডিউটি অফিসার) মেজর মহিউদ্দিন আহমেদকে লাশের সঙ্গে টুঙ্গিপাড়া যাওয়ার খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দেওয়া হয়। একটি বিএএফ (বাংলাদেশ এয়ারফোর্স) হেলিকপ্টারযোগে লাশ দাফনের জন্য টুঙ্গিপাড়া নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মৃতদেহের গোসল ও জানাজা দেওয়া হয়। জানাজায় শেখ মুজিবের চাচাসহ ডজনখানেক লোক শরিক হন! একটি অস্থায়ী চৌকি বসিয়ে কবরটি পাহারার জন্য রক্ষী মোতায়েন করা হয়। জিডিও টুঙ্গিপাড়া থেকে ফিরে সদর দপ্তরের মিলিটারি অপারেশনসের ডিরেক্টরের কাছে তাঁর রিপোর্ট পেশ করেন।

৬. নিহতদের বাড়িগুলো সিল করা হয়: শেখ মুজিব, শেখ মণি ও সেরনিয়াবাতের বাড়ি তালাবদ্ধ করে সিলগালা করা হয় এবং চাবি স্টেশন সদর দপ্তরে রাখা হয়।

৭. অনেক বাধাবিপত্তি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আমরা আমাদের সাধ্যমতো সর্বোচ্চ যত্ন ও মর্যাদার সঙ্গে অর্পিত দায়িত্ব পালন করি।

বনানী গোরস্থান: সাত নম্বর সারিতে যাঁদের কবর দেওয়া হয়

১. বেগম মুজিব, ২. শেখ নাসের, ৩. শেখ কামাল, ৪. সুলতানা কামাল, ৫. শেখ জামাল, ৬. রোজী জামাল, ৭. শিশু রাসেল, ৮. অজ্ঞাত পরিচয় ১০ বছর বয়সী একটি বালক, ৯. ফাঁকা, ১০. অজ্ঞাত পরিচয় ১২ বছর বয়সী একটি বালক, ১১. গৃহপরিচারিকা, বয়স ৪৫, ১২. অজ্ঞাত পরিচয় ১০ বছর বয়সী একটি ফুটফুটে বালিকা, ১৩. শেখ মণি, ১৪. মিসেস মণি, ১৫. অজ্ঞাত পরিচয় ২৫ বছর বয়সী এক যুবক, ১৬. অজ্ঞাত পরিচয় ১২ বছর বয়সী একটি বালক, ১৭. আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ১৮. অজ্ঞাত পরিচয় ২৫ বছর বয়সী এক যুবক।

নোট: নয় নম্বর কবরের নাঈম খানের লাশ লে. আবদুস সবুর খানের (এনওকে) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল।
মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ
আর্টিলারি স্টেশন স্টাফ অফিসার
স্টেশন হেডকোয়ার্টার্স, ঢাকা সেনানিবাস, ঢাকা।
১৮ আগস্ট, ১৯৭৫
প্রথম আলো ১৫ আগস্ট ২০০৩ থেকে পুনর্মুদ্রিত

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্লট নির্মাণে কর্নেল ফারুক এবং কর্নেল রশিদ ও মেজর জেনারেল জিয়ার সংশ্লিষ্টতা

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা ফারুক ও রশীদের সঙ্গে পেছনে লুকিয়ে থাকা নাটের গুরু জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফসুলজের এনাটমি অফ এ ক্যুপ্রতিবেদনটির সত্যতা প্রমাণিত হয় যখন ফারুক এবং রশীদ উভয়েই ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে সানডে টাইমসের সাংবাদিক এন্থনি মাসকারেনহাসকে ১৫ই আগস্ট প্রসঙ্গে সাক্ষাতকার দেয় । আসুন ভিডিওটি দেখি

লেটেন্ট ওয়ার্ডস অব মুজিব কিলিং

কর্নেল ফারুক এবং কর্নেল রসিদ বলছে কেন তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ছিল।

এন্থনিঃ তোমরা কি তোমাদের মতাদর্শে প্রত্যাবর্তনের কথা মুজিবকে বোঝানোর চেষ্টা করে ছিলে ?

রশিদঃ না ! আমাদের লেভেলের জুনিয়ার অফিসারদের সেই সুযোগ ছিল না।

এন্থনীঃ মুজিবকে হত্যা না করে তোমাদের লক্ষ্য অর্জন কি সম্ভব ছিল না ?

রশিদঃ না, তাঁর ভেতর সাধারন গনমানুষকে আন্দোলিত করার আশ্চর্য এক ক্ষমতা ছিল। তাকে জীবিত রেখে কোন অভ্যুথান বা ক্যু ঘটাতে গেলে অনেক সমস্যা মোকাবেলা করতে হতো। অধিকন্তু তিনি ছিলেন খুবই অভিজ্ঞ একজন রাজনীতিবিদ তাই তার যে কোন তৎপরতায় আমরা পরাজিত হতাম এবং দেশটাই হারাতাম ।

এন্থনীঃ তো তোমরা বলছ মুজিব বেঁচে থাকলে সাধারন গনমানুষকে নিয়ে তোমাদের এই ক্যু ব্যর্থ করে দিত ?

রশিদঃ হ্যাঁ তাই হতো। তাই তাকে হত্যাই ছিল আমাদের মতাদর্শ পুনপ্রতিষ্ঠার একমাত্র পথ।

এসাইনম্যান্ট চুড়ান্ত করে হত্যাকারী জুনিয়র কর্নেলের এ দলটির তাদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য একই মতাদর্শের সবচেয়ে যোগ্য একমাত্র ব্যক্তি হিসাবে যাকে বিবেচনা করলো তিনি ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান।

ফারুকঃ আমাদের লীড করার জন্য জেনারেল জিয়াই ছিল মতাদর্শগত ভাবে যোগ্যতম ও বিশ্বস্ত ব্যাক্তি। তার সাথে দেখা করলাম ২০ শে মার্চ ১৯৭৫, জনারেল জিয়া বললেন একজন সিনিয়র অফিসার হিসাবে আমি তোমাদের এই টিমে সক্রীয় হতে পারি না, তোমরা জুনিয়র অফিসাররা এই অংশটা চালিয়ে যাও।

ফারুকঃ এর পর লনে হাটতে হাটতে বললাম, স্যার ! আমরা প্রফেশনাল সোলজার। আমরা প্রফেশনাল কীলারের মত কোন একক ব্যক্তিকে সার্ভ করবো না। আমরা আপনার এবং আমাদের মতাদর্শের বিজয় দেখতে চাই। এ মিশনে আপনার সমর্থন ও নেতৃত্ব অনিবার্য।

এন্থনীঃ রশিদ ! মুজিবকে হত্যার পর তুমি আর ফারুক মুশতাকের সাথে দেখা কর। তোমরা কি আগে তার সাথে প্ল্যান করেছিলে ?

রশিদঃ হ্যাঁ! আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে মুশতাকের সাথে আমাদের সংযোগ ঘটানো হয়। পরে প্রস্তুতি শেষে ১৪ আগষ্ঠ ১৯৭৫ দেখা করি ।

এন্থনীঃ মুজিবকে হত্যার পরিকল্পনা তার সাথে আলোচনা করেছিলে ?
রশিদঃ না ! এভাবে সরাসরি বলিনি তবে ইসারায় বুঝিয়েছি আপনি এবং আমরাদের মতাদর্শ পুনপ্রতিষ্ঠার জন্য মুজিবকে হত্যার সব প্রস্তুতি সম্পূর্ন হয়েছে এবং আমাদের গোষ্ঠির সকলে প্রস্তুত আছে।

ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে এসাইনমেন্ট চূড়ান্ত করে হত্যাকারী জুনিয়র কর্নেলের এ দলটি তাদেরকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য একই মতাদর্শের সবচেয়ে যোগ্য একমাত্র ব্যক্তি হিসেবে যাকে বিবেচনা করলো তিনি ছিলেন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান । লিফশুলজও একই কথা বলেন, তার সেই সোর্সের বরাতে তিনি জানান, মোশতাক নয়, ফারুক রশীদদের ই্চ্ছে ছিলো এই অভ্যুত্থানকে একটা পূর্ণাঙ্গ সামরিক রূপ দিতে। অর্থাৎ মুজিব হত্যার পর একটি মিলিটারি কাউন্সিল গঠন করে দেশ শাসন। আর এর নেতৃত্বে জিয়াই ছিলো তাদের একমাত্র এবং গ্রহনযোগ্য পছন্দ। লিফশুলজের Anatomy of a coup থেকে জানা যায় -

General Zia, who was then Deputy Chief of the Army, expressed continuing interest in the proposed coup plan, but also expressed reluctance to take the lead in the required military action. The junior officers had already worked out a plan, Rashid told Zia, and they wanted his support and leadership. Zia temporised. According to the account given by Rashid to Mascarenhas and confirmed by my source, Zia told him that as a senior officer he could not be directly involved but if they junior officers were prepared, they should go ahead. According to my unusual source, the Majors hoped right up until the end that Zia would take the lead in the coup. Their view was that the best option would be not to bring in Mustaque with whom they were in constant, yet discreet, contact. The best option from the Majors perspective was to establish a Military Council as the commanding authority after the coup. In fact, it was largely Rashid who was in charge of defining the options for his group. It was their hope that Zia would lead such a council. While the junior officers might have preferred a senior officers’ coup with Zia at the head, they secured the next best option. With General Zia’s neutrality or even tacit support assured, the junior officers could move ahead without fear that Zia would throw his forces against them at the crucial moment.

ফারুকের ভাষ্যমতে সুস্পষ্টভাবেই প্রথম পছন্দ ছিলো জেনারেল জিয়া যে তাদের মতই মনেপ্রাণে একই মতাদর্শের ছিল । তার সঙ্গে ১৯৭৫ সালের ২০ শে মার্চ তারা দেখা করে এবং চরম কৌশলী জিয়াউর রহমান সরাসরি সামনে আসতে না চেয়ে বিষয়টির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বললো

আমি সিনিয়র অফিসার, তাই তোমাদের সঙ্গে এই টিমে আমি সরাসরি সক্রিয় হতে পারিনা, তবে তোমরা জুনিয়র অফিসারেরা যদি তাকে হত্যা করতে চাও, তবে গো এহেড

অর্থাৎ জিয়া মনে মনে চাইছিলো, বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হোক, কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড সফল হবে কি হবেনা সেটি নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত জিয়াউর রহমান নিজেকে আড়ালে রাখারই সিদ্ধান্ত নেন ।

এন্থনি মাসকারেনহাসের এ লেগাসি অব ব্লাডে এই ঘটনাগুলো উল্লেখিত হয়েছে ।

পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক লরেঞ্জ লিফসুলজ এবছর ফেব্রুয়ারী মাসে বাংলাদেশ সফরে এসে বলেছেন -

Ziaur Rahman was in the shadow of the whole episode of August 15, 1975 because he was very much one of the main players of the game.

হাইকোর্টের এক প্রশ্নের জবাবে লিফশুলজ বলেন,

Ziaur Rahman could have stopped the assassination of Sheikh Mujibur Rahman because he (Zia) knew the plot

যেহেতু জিয়াউর রহমান হত্যা পরিকল্পনার বিষয়টি জানতেন, সেহেতু তিনি চাইলে মুজিব হত্যাকাণ্ডকে রুখতে পারতেন কিন্তু সেটি তিনি করেননি । ১৯৭১ সালে গা বাঁচিয়ে সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করা ভীরু কাপুরুষ জিয়াউর রহমান এখানেও তার গা বাঁচানো নির্লজ্জ কাপুরুষতা অব্যাহত রাখে সরাসরি বিষয়টিতে জড়িত না থাকার মধ্য দিয়ে। জিয়াউর রহমান যদি ২০শে মার্চের পরে বঙ্গবন্ধুকে ঘটনার সবকিছু খুলে বলতো, তাহলে একটা কথা ছিলো, কিন্তু এই ঘটনা গোপন রেখে কার্যত সে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ইন্ধন যুগিয়েছে এবং গো এহেড বলে তার সমর্থন প্রদান করেছে উপরন্তু ঘটনা গোপন রেখে একজন মানুষকে মেরে ফেলায় ভূমিকা রেখেছে, অর্থাৎ নিশ্চিতভাবেই বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়ার সংশ্লিষ্টতা ছিলো এবং সে ১৯৮১ সালে মারা না গেলে আজকে তারও বিচার করা যুক্তিযুক্ত ছিলো ।

তবে ফারুক ২০শে মার্চের কথা উল্লেখ করলেও লিফশুলজ বলেন

my source described how both Mustaque and General Ziaur Rahman had been in contact and discussions with the Majors for more than six months prior to the actual coup. This individual had personally attended numerous meetings that Major Rashid had held separately with Zia and Mustaque. In his television interview with Anthony Mascarenhas, Rashid described a meeting with General Zia on March 20, 1975, in which a coup was discussed in detail. This meeting took place five months before the coup. My source attended this meeting with General Zia but claimed it was not the first in which plans for a coup were discussed.

অর্থাৎ, ২০শে মার্চের আগেও জিয়া মোশতাক ফারুক গংদের মধ্যে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে সূত্র মোতাবেক লিফশুলজ খবর পেয়েছেন বলে দাবী করেছেন। ২০শে মার্চই হোক আর তার আগেই হোক, মাসকারেনহাস ইন্টারভিউ থেকে সুস্পষ্ট যে তাদের মধ্যে মুজিব হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতা ছিলো ।

আরো উল্লেখযোগ্য তথ্য হলো লিফশুলজ তাঁর বাংলাদেশী সোর্স মোতাবেক জেনেছিলেন মোশতাক এবং জিয়া উভয়েই ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেলে আমেরিকার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন এই হত্যাকাণ্ডে আমেরিকা তাদের সহায়তা করবে কিনা। কর্নেল রশীদের প্রশ্নের জবাবে দুজনেই বলেন আমেরিকা তাদের সঙ্গে রয়েছে । সোর্স থেকে জানা যায়

Major Rashid independently raised a question concerning what the attitude of the United States would be to the planned coup. “Both Zia and Mustaque independently told us that they had checked with the Americans,” said this military officer. “Their answers were the Americans. I then realized that Zia and Mustaque had their separate channels to the Americans

শাহাদুজ্জামানের ক্রাচের কর্নেল থেকে জানা যায়

ঘটনার খানিক পর কর্ণেল রশীদের ফোন পান সেনানিবাসে অবস্থানরত ব্রিগেডিয়ার শাফায়াত জামিল। ঘটনায় হতভম্ব ও উদভ্রান্ত অবস্থায় তিনি ছুটে যান কাছেই উপ সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের বাসায়। উত্তেজিত অবস্থায় দরজা ধাক্কাতে থাকেন তিনি, বেরিয়ে আসেন জিয়া। পরনে স্লিপিং ড্রেসের পায়জামা ও স্যান্ডো গেঞ্জি। এক গালে শেভিং ক্রিম লাগানো। শাফায়াত উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন,

দ্য প্রেসিডেন্ট ইজ কিল্ড

শুনে জিয়া অবিচলিত। তার শান্ত প্রতিক্রিয়া-

প্রেসিডেন্ট ইজ ডেড সো হোয়াট? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার ।গেট ইউর ট্রুপস রেডি। আপহোল্ড দ্য কনস্টিটিউশন।

একটু পরেই চিফ অব জেনারেল স্টাফ খালেদ মোশাররফের সাথে সাথে জিয়াও সেনাসদরে এসে উপস্থিত। ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় সেনাপ্রধান শফিউল্লাহর জরুরী তলব পেয়ে এসেছেন তারা। খালেদের পরনে শার্ট ও পায়জামা, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। নিজেই গাড়ি চালিয়ে এসেছেন। জিয়া এসেছেন ক্লিন শেভ ও মেজর জেনারেলের এক্সিকিউটিভ পোশাকে ড্রাইভার চালিত সরকারী গাড়িতে । জিয়ার এরকম পূর্বপ্রস্তুতিমূলক ফিটফাট হয়ে থাকা এবং ভাবলেশহীন শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠস্বর যথেষ্ট প্রশ্নের উদ্রেক ঘটায় যে তিনি নিশ্চয়ই আগেই থাকেই জানতেন, না জানলে তারও খালেদের মত অগোছালো অবস্থায় হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসার কথা ছিলো ।

কেন জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে সামনে না এসে পেছন থেকে সংশ্লিষ্ট ছিলেন ?

জিয়াউর রহমান কিন্তু অখ্যাত মেজর নন, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে হিলাল-ই-জুরাত পদক জোটে তার (সূত্র : উইকিপিডিয়া ও পাক ডিফেন্স ফোরাম)। পাক সেনাবাহিনীর এটা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বীরত্বের পদক (নিশান-ই-হায়দার হচ্ছে সর্বোচ্চ যা জীবিতরা পান না,যেমন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বীরশ্রেষ্ঠ। পাকিস্তানে দীর্ঘসময় থাকার কারণে এবং পাক সরকার কর্তৃক উক্ত পদক জেতার কারণে জিয়াউর রহমান মনেপ্রাণে ছিলেন পাকিস্তানপন্থী, যার জন্য ১৯৭১ সালে পাক বাহিনীর পক্ষে অস্ত্র খালাস করতে গিয়েছিলেন এবং জুনিয়র অফিসারদের চাপে পড়ে পক্ষ বদল করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের পরে বাংলাদেশের গুণগান তাকে গাইতেই হয়, কেননা পাকিস্তানকে যতই ভালভাসুন না কেন, বাঙালি বলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে কখনোই তিনি উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত হতে পারতেন না, তাই ভেতরে পাকিস্তান প্রেম বজায় রেখে এবং মুখে বাংলাদেশের গুণকীর্তন করে তিনি বাংলাদেশে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার স্বপ্ন দেখেছেন। আর পাকিস্তান প্রেমের কারণে পাকিস্তান থেকে রাজাকার শাহ আজিজুর রহমানকে দেশে ফিরিয়ে এনে প্রধানমন্ত্রীত্ব দিয়েছেন, রাজাকার আব্দুল আলিমকে মন্ত্রী বানিয়েছেন, জামাত নেতা গোলাম আজমকে পুনর্বাসিত করেছেন।

জিয়াউর রহমান ছিলেন ধীরস্থির এবং কৌশলী। তিনি উচ্চাভিলাষী ছিলেন, এজন্য নিজেই কালুরঘাট থেকে বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যতীত একটি ঘোষণা দিয়েছিলেন যেটি সম্প্রচারিত করা হয়নি। তাকে একাত্তরের রনাঙ্গনেও সম্মুখ যুদ্ধে দেখা যায়নি, কিন্তু তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষক বলে ইতিহাসে একটি শক্তস্থানে বসে যান, ইসলামিক মনোভাবের কারণে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনকারী আর্মির উচ্চপদস্থ সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মান্ধ ব্লকটির কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং এদেশের সাধারণ জনগণের মধ্যেও সেই মনোভাবের প্রভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠেন । মুজিব হত্যার যে সুদূরপ্রসারী ফলাফল হতে পারে, অভ্যুথান আদৌ সফল হবে কিনা সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কারণে এবং সফল না হলে জাতির কাছে তিনি চিরকালের মত কলংকিত হয়ে যেতে পারেন এই আশংকায় তিনি মুজিব হত্যার সকল দায় নিজের কাঁধে নিতে অনাগ্রহী ছিলেন। লিফশুলজের বর্ণনায়

The Majors hoped until the last that Zia would take command of a new military Council that would be set up in the immediate aftermath of the coup. Even on August 15th they believed this was still a possibility. But, according to this source, Zia stepped back into the shadows once it emerged that a massacre had occurred at Mujib’s house and the houses of other relatives in which women and children were mercilessly killed alongside their menfolk. According to this source, Rashid himself was shocked at the killings and believed in the years that followed that there had been a “hidden plan” submerged within the coup that he neither knew about nor controlled.

মুজিব হত্যার প্রধান বেনিফিসিয়ারী কে ? – মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ২০শে মার্চই তা সুস্পষ্ট হয় ফারুক গংয়ের তাকে নেতা হিসেবে মেনে নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশের মাধ্যমে। পরবর্তীতে খালেদ মোশাররফকে হত্যার নির্দেশ দিয়ে এবং জিয়াকে মুক্ত করে আনা কর্নেল তাহেরকে বন্দী করে ও পরবর্তীতে বাংলাদেশের সর্বময় ক্ষমতা দখল করে জিয়া প্রমাণ করে দেন এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান বেনেফিসিয়ারী জিয়াই ।

হাই রেজুলেশনে দেখুনঃ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ

ইতিহাসের জঘণ্যতম বর্বর হত্যাকান্ড ১৫ আগষ্ট হত্যাকাণ্ডকে বিচারের আওতামুক্ত রাখতে খোন্দকার মোশতাক ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর জারি করেন ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তার অনুগত জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাস করিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট হতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত জারি করা সকল সামরিক আইন-বিধি কার্যক্রমকে বৈধতা দেন। শুধু তাই নয়, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার দায়ে যাদের বিচার হবার কথা,সেই খুনিদের আখ্যায়িত করা হলো সূর্যসন্তানবলে! পুনর্বাসিত করা হলো উচ্চপদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে। জেনারেল জিয়া এবং এরশাদের সামরিক সরকার তা বহাল রাখল বহু বছর। এরপর থেকে ক্ষমতাসীন কোন সরকারই বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের বিষয়ে কোন উদ্যোগ নেয়নি,বরং খুনিদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে এমনকি পুরস্কৃতও করেছে।

১৯৭৬ সালের ৮ জুন ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকার দায়ে অভিযুক্ত হত্যাকারী গোষ্ঠীর ১২ জনকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়েছিল। যেমন:

১. লে. কর্নেল শরিফুল হককে (ডালিম) চীনে প্রথম সচিব,
২. লে. কর্নেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব,
৩. মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব,
৪. মেজর বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব,
৫. মেজর শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব,
৬. মেজর রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব,
৭. মেজর নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব,
৮. মেজর শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব,
৯. কর্নেল কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব,
১০. লে. খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব,
১১. লে. নাজমুল হোসেনকে কানাডায় তৃতীয় সচিব,
১২. লে. আবদুল মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

তাঁদের নিয়োগপত্র ঢাকা থেকে লিবিয়ায় পৌঁছে দিয়েছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তত্কালীন কর্মকর্তা ও পরবর্তীকালে পররাষ্ট্রসচিব শমসের মবিন চৌধুরী। এর আগে ওই বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে তাঁদের সঙ্গে আলোচনা-সমঝোতার জন্য ঢাকা থেকে তত্কালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুল ইসলাম (শিশু) ঢাকা থেকে লিবিয়া গিয়েছিলেন। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জিয়াউর রহমানের নির্দেশে খুনিদের বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (ফরেন সার্ভিস ক্যাডার) অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়। সে সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে এসব জানা গিয়েছিল।

তবে ১২ জন সেনা কর্মকর্তা চাকরিতে যোগ দিতে রাজি হলেও ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের প্রধান দুই হোতা কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ও কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা ও চাকরি গ্রহণে অসম্মতি জানিয়েছিলেন। তাঁরা ব্যবসা-বাণিজ্যে লিবিয়ায় প্রেসিডেন্ট কর্নেল গাদ্দাফির সব ধরনের সহযোগিতা পান।

সত্তরের দশকের শেষে রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাসনামলে আমরা এ তথ্য জেনেছিলাম যে, বিদেশে অবস্থানরত খুনি গোষ্ঠীর শরিফুল হক (ডালিম), আজিজ পাশা, বজলুল হুদা এবং নূর চৌধুরীসহ এই অভিযুক্তরা ১৯৮০ সালের ১৭ জুন ঢাকা সেনানিবাসে একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছিলেন। সেনাবাহিনী অগ্রিম খবর পেয়ে তা ব্যর্থ করে দেয়। ঢাকায় অভ্যুত্থান-প্রয়াসীদের গ্রেপ্তার করে সামরিক আইনে বিচারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ঢাকার রাজনৈতিক সূত্রগুলোর মাধ্যমে এসব খবর আমরা জেনেছিলাম।

সেনাবাহিনীর অনুসন্ধানে শরিফুল হক (ডালিম), আজিজ পাশা, বজলুল হুদা ও নূর চৌধুরীর সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছিল। তাঁদের সঙ্গে ফারুক ও রশিদের সরাসরি যুক্ত থাকার তথ্যও পেয়েছিল কর্তৃপক্ষ। তাঁরা উগ্র বামপন্থীদের সঙ্গে মিলে এ অভ্যুত্থান করতে চেয়েছিলেন। ১৯৭৯ সালের মে মাসে ইসলামাবাদ, পরে তেহরান ও আঙ্কারায় বিভিন্ন সময়ে বৈঠক করে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা করেছিলেন। এ সময় তাঁরা একাধিকবার ঢাকায় বৈঠক করেন। সর্বশেষ ১৯৮০ সালের মে মাসে ঢাকায় চূড়ান্ত সভা হয়েছিল; তাতে ডালিম, পাশা ও হুদা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন জেল থেকে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কর্নেল ফারুক রহমান। এখানে উল্লেখ্য যে, ১৯৭৭ সালের কোনো একসময়ে ফারুক গোপনে ঢাকায় এসে অবস্থানকালে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আটক ছিলেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জিয়াউর রহমান ও এরশাদকে হত্যা করে দেশে ইসলামি সমাজতন্ত্রপ্রতিষ্ঠা করা। এসব তথ্য আরও বিস্তারিত জানা যায় ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেনের বাংলাদেশ: রক্তাক্ত অধ্যায় গ্রন্থ থেকে। ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেনকে (বর্তমানে নির্বাচন কমিশনার) বিদ্রোহ-পরবর্তী সেনাসদস্যদের বিচারের জন্য সেনাবাহিনী থেকে সরকারি কৌঁসুলি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে গেলে ডালিম, হুদা ও নূর বিদেশে নিজ নিজ কর্মস্থল ত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যান। আজিজ পাশা তখন ঢাকায় থাকায় গ্রেপ্তার হন। তিনি রাজসাক্ষী হতে রাজি হন এবং পরে তাঁকে চাকরিতে পুনর্বহাল করে সরকার কূটনীতিকের দায়িত্ব দিয়ে রোমে পাঠায়। পরবর্তী সময়ে তাঁকে ঢাকায় পররাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। পরে ডালিম, হুদা ও নূরকেও বিভিন্ন দেশে আবার কূটনীতিকের দায়িত্বে পুনর্বহাল করা হয় এবং তাঁরা একাধিক পদোন্নতি পান।

অসৎ এবং বিবেকবর্জিত নারী, মানুষ নামের কলংক বেগম খালেদা জিয়া ও ভুয়া জন্মদিন



চিত্রঃ মানুষ কতটা অসৎ এবং বিবেকবর্জিত হলে এরকম ঘৃণ্যকর্মে লিপ্ত হতে পারে !

২০০১ সালে বি এন পি ক্ষমতায় এসে জাতীয় শোক দিবস এবং ছুটি বাতিল করে। আর জাতির জনকের মৃত্যুবার্ষিকীতে নষ্ট ভ্রষ্ট মহিলা খালেদা জিয়া বিভিন্ন রঙের শিফন জর্জেট শাড়ী পরে চরম নির্লজ্জ বেহায়াপনায় কেক কেটে তার ভুয়া জন্মদিন পালন করতো । জাতির জনকের মৃত্যুতে এরূপ অশ্লীল পৈশাচিক উল্লাসে রত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জাতির জনককে অবমাননা করার দায়ে মামলা এবং সমুচিত শাস্তি হওয়া উচিত ।

গণভবনে বাস করলে হয়তো এই সামরিক অভ্যুত্থান সফল হতো না। যুক্তি হিসেবে বলা যায়

১) গণভবনে সুরক্ষার পরিমাণ অনেক বেশি ছিলো।
২) রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প কাছেই ছিলো
৩) গণভবনে ক্র্যাকডাউন করার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন ছিলো, সেই সময়ে সাহায্য পৌঁছেও হয়তো যেতে পারতো।

তবে এমন নাও হতে পারতো, কেননা যেভাবে ধানমন্ডির ৩২ নং বাসার গার্ডদের নিরস্ত্র করা হয় এবং যেভাবে ৩০টা ট্যাংক ঢাকা শহরে মোতায়েন করা হয় তথা রক্ষী বাহিনীর ক্যাম্পের দিকে তাক করা থাকে , তাতে বোঝা যায় কতটা সুপরিকল্পিত ছিলো ষড়যন্ত্রের নীলনকশা। ঢাকা থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে সাভারে ছিলো রক্ষীবাহিনীর সদর দফতর, কেউ কেউ চাচ্ছিলেন পাল্টা যুদ্ধ করতে, কিন্তু তাদের কাছে এন্টি ট্যাংক গান ছিলোনা। এখানেও ষড়যন্ত্রকারীরা কতটা পরিকল্পনাবদ্ধ যে হত্যাকাণ্ডটি এমন সময়ে চালানো হলো যখন সারা ঢাকার মানুষ ঘুমে আচ্ছন্ন এবং রক্ষীবাহিনীর মহাপরিচালক নুরুজ্জামান বিদেশে লন্ডনে অবস্থান করছেন যাতে তিনি কোন নির্দেশ না দিতে পারেন।

আমেরিকা ও পাকিস্তান সরকার, সিআইএ এবং আইএসআইয়ের সংশ্লিষ্টতা

বিদেশী চক্রান্তের মধ্যে রয়েছে আমেরিকান সিআইএ, পাকিস্তানের ভুট্টো এবং আইএসআই সহ কতিপয় ইসলামিক দেশের ষড়যন্ত্র। ১৫ই আগস্ট ভুট্টো শুধুমাত্র পাকিস্তানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের নতুন শাসনকে স্বীকৃতিই দিলেন না বরং ৩য় বিশ্বের দেশগুলোর কাছেও বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আবেদন জানালে, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর প্রতি। মুজিব হত্যাকাণ্ডের পরপরই ভূট্টো বাংলাদেশের মানুষের জন্য সাহায্য পাঠানোর কথা ঘোষণা করে বলেন

বাংলাদেশের জনগণের জন্য অতিশীঘ্র ৫০০০০ টন চাল, এক কোটি গজ মোটা কাপড় ও ৫০ লক্ষ গজ মিহিকাপড় উপহার স্বরূপ পাঠানো হবে এবং ভবিষ্যতেও আমাদের সাধ্যমত সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
মুজিব হত্যার উপহার ?

দেখুন- ভুট্টো বাঙালিকে শুয়োয়ের বাচ্চা জাহান্নামে যাক বলে গালি দিচ্ছে

অথচ ১৯৭৪ সালে এরকম সামান্যতম কোন সাহায্য সহযোগিতার কথা ভুট্টো বলেননি। যেই ভুট্টো তার দেশের জনসভায় আমাদের দেশের বিরুদ্ধে কিরকম হিংস্র এবং আক্রমণাত্মক ভাবে আমাদেরকে শুয়োর কা বাচ্চা জাহান্নাম মে জায়ে বলে গালি দিচ্ছে, সেই ভুট্টোর কেন হঠাৎ এই ক্রোকোডাইল টিয়ার বা কুমিরের কান্নার ছদ্মাভিনয় ? বঙ্গবন্ধু নিহত এবং মোশতাক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে ভুট্টোর তাৎক্ষণিক কূটনৈতিক অবস্থান ও সাহায্য প্রেরণ সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ করে, মোশতাক সরকার এবং আর্মিরা ভুট্টোর পছন্দনীয় ছিলো এবং এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে ভুট্টো আগে থেকেই কিছু না কিছু জানতেন, নাহলে হঠাৎ করে এত ঔদার্য (ছদ্ম) দেখানো সম্ভব নয়।

মার্কিন সরকার এবং সিআইএর ষড়যন্ত্র ( ডিক্লাসিফাইড ডকুমেন্টের অসংলগ্নতা )

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে নিশ্চিতভাবেই মার্কিন ষড়যন্ত্র ছিলো। কেননা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের ২৫ বছরের অধিক পুরনো ডিক্লাসিফাইড দলিল থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের নেপথ্যে মার্কিন সরকার বা গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততা নিয়ে বিভিন্ন অসঙ্গতিপূর্ণ বক্তব্য লক্ষ্যণীয় হয়।

এসব দলিলের কোথাও দেখা যায়, ১৯৭৫ সালের মার্চেই আমেরিকা বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করেছিলো যেটি হতেই পারেনা কেননা ১৯৭১ সালের নিক্সন সরকার পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলো এবং তার পররাষ্ট্র সচিব হেনরী কিসিঞ্জার চরম মুজিববিদ্বেষী ছিলো। চরম বিদ্বেষী ব্যক্তি কখনোই তার শত্রুকে সতর্ক করেনা, এটা কমন সেন্সের ব্যাপার। এই ডিক্লাসিফাইড ডকুমেন্ট আসলে আসল ঘটনাকে ধামাচাপা দেওয়ার পাঁয়তারা। আবার সেই দলিলেরই কোথাও দেখা যাচ্ছে, এবিষয়ে হেনরী কিসিঞ্জার মুজিবকে সতর্ক করার কথা দাবী করলেও দেখা যাচ্ছে, এথারটন এবং হাইল্যান্ড বলছেন মুজিবকে নাম বলা হয়েছিলো কিনা তা চেক করতে হবে (এথারটন) এবং তারা এই ব্যাপারে সম্যকভাবে কিছুই বলেনি (হাইল্যান্ড) মন্তব্য করেন। অর্থাৎ তিন ধরনের অস্পষ্ট ব্ক্তব্য। দুই ধরনের পরস্পরবিরোধী বক্তব্যের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়, এই দলিলের অনেক কিছুই স্রেফ ভাঁওতাবাজি বা আই ওয়াশ। আবার ২০০৫ সালে কতিপয় মার্কিন সাংবাদিকদের অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে মার্কিনী সংশ্লিষ্টতা ছিলো। লরেঞ্জ লিফশুলজের গ্রন্থের মাধ্যমে স্পষ্ট হয় যে, এই হত্যাকাণ্ডে মার্কিন সরকার এবং জিয়াউর রহমানের সংশ্লিষ্টতা ছিলো। আবার বাংলাদেশ সম্পর্কিত ডিক্লাসিফাইড ডকুমেন্টে এই হত্যাকাণ্ডের কথা মার্কিন সরকার জানতো বলে স্বীকার করলেও ১৯৭৫ সালের অক্টোবরে হেনরী কিসিঞ্জার ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান যে, তারা এই হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। ব্যারিস্টার কামাল হোসেন আমেরিকা ও পাকিস্তানের সংশ্লিষ্টতার কথা জোরকণ্ঠে দাবী করেন এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ ডঃ ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন সবসময় যে অফিশিয়াল ডকুমেন্টে সব সত্যই লেখা থাকবে এমনটি নয় এবং সেখানে অনেক লুক্কায়িত কথাবার্তা থাকতে পারে। বাস্তবেও দেখা যায়, ঐ ফাইলটিতে অমিটেড লিখে কিছু অংশ মুছে ফেলা হয়েছে এই দাবী করে যে, সেগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কিত নয়। সেখানে যে কোন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ছিলোনা সেটাই বা কে বলতে পারে ? আবার ২৫ বছর পর হঠাৎ এই ফাইল অবমুক্ত করাটাও কোন যুক্তির কথা নয়। যদি এটি অবমুক্ত করাই হলো, তো অমিটেড অংশ অবমুক্ত করা হলোনা কেন ? প্রশ্ন থেকেই যায়।

ফারুক-রশীদ গংয়ের মত একই মতাদর্শী ভাসানীর মুজিববিদ্বেষ এবং আওয়ামী বিদ্বেষ ও হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন প্রদান

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে ভাসানীর সক্রিয় অংশগ্রহণ না থাকলেও কর্নেল ফারুক রশীদ এবং মোশতাক গংদের বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে গড়ে তোলার মতাদর্শের সঙ্গে ভাসানীর চরম মিল ছিলো এবং তারা সকলেই ছিলো চরমভাবে ভারতবিদ্বেষী। আর মুজিব নিহত হওয়ার পর মুজিব ও মুজিব সরকারকে উৎখাতে মোশতাক ও খুনী বিপথগামী আর্মি অফিসারদের সাহসের তারিফ করে অভিনন্দন জানিয়ে ভাসানী তাদের একটি তারবার্তা পাঠান।

এর মাধ্যমে ভাসানীর মত ব্ল্যাকশিপের ছদ্মবেশী চরিত্রটি সকলের সামনে প্রকটিত হয়ে পড়ে। মুজিব সবসময়ই ভাসানীকে শ্রদ্ধা করতেন এবং তাঁর ছেলেরা কখনো ভাসানীর পাগলামিপূর্ণ উদ্ধত বক্তব্যের সমালোচনা করলে তাদের তিনি ভর্ৎসনা করতেন। কিন্তু হীনমন্য ও সুবিধাবাদী ভাসানী চিরকালই মুজিবের জনপ্রিয়তায় চরম ঈর্ষান্বিত বোধ করতেন, তাঁর প্রতি ঈর্ষাপ্রসূত বিদ্বেষ পোষণ করতেন। এজন্যই তিনি নিজের রাগ ও ক্ষোভ সংযত করতে না পেরে ১৯৭০ সালে বলেছিলেন আমার লাশের ওপর দিয়ে মুজিব ক্ষমতায় আসবে । মুজিবের প্রতি ভাসানীর বিদ্বেষের কারণ হলো

ক) ১৯৪৮ -১৯৫৮ পর্যন্ত ভাসানী ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা, কিন্তু মুজিব যেভাবে সঘনে শ্রাবণে প্লাবনের বেগে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির শীর্ষ নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন তাতে ভাসানীর মত ব্যক্তি সেই প্লাবনে খড়কুটোর মত ভেসে গেলেন । এখানেই ভাসানীর ভেতরের খেদ এবং ঈর্ষা ।

খ) ভাসানী চীনপন্থী এবং ভারতবিদ্বেষী ছিলেন যেই চীন ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে এবং সেখানে ভারত আমাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছে । মুজিব কোন পন্থী ছিলেন না, তবে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাঁর চমৎকার সম্পর্ক ছিলো। এটি ভাসানী সহ্য করতে পারতেন না । এই ভাসানীই পুনরায় লাইমলাইটে আসার জন্য গোপনে ভারতের সঙ্গে কনফেডারেশন করতে চেয়েছিলেন। অথচ মিডিয়াতে পাত্তা পেলেন না, ভাসানী হয়ে গেলেন গৌণ এবং মুজিব হয়ে গেলেন মুখ্য । এটি ভাসানীকে মুজিববিদ্বেষী করে তোলে।

ভাসানী ১৯৭০ সালের একুশে মার্চ লাহোরে পৌঁছে ঘোষণা দেন যে সরকার জনগণের ওপর জোর করে নির্বাচন চাপিয়ে দিলে তিনি গেরিলা যুদ্ধ শুরু করবেন, যার জন্য তার ৩০০০০ সশস্ত্র লোকও আছে । নির্বাচন হওয়াই ছিলো যৌক্তিক এবং মাত্র ৩০০০০ সৈন্যের ধারণা শিশুসুলভ চপলতা বৈ কিছুই নয়।

মুজিব হত্যায় ভাসানীর সক্রিয় সংশ্লিষ্টতা না থাকলেও খুনী সরকার ও বিপথগামী আর্মি অফিসারদের অভিনন্দন জানিয়ে ভাসানীও মুজিব হত্যায় পরোক্ষভাবে নিজের নামকে কলংকিত করেছেন। ভাসানীর মত সুবিধাবাদী রাজনৈতিক চরিত্র আমাদের দেশে প্রচুর। রিপোর্ট মোতাবেক চুক্তির ৪৪০০০ কিউসেক পানি পাওয়ার পরেও এই ভাসানীই তথাকথিত লং মার্চ করে আমাদের মধ্যে জাতিবিদ্বেষ (ভারতবিদ্বেষ) পয়দা করেছেন এবং সাম্প্রদায়িকতাকে আরো উস্কে দিয়েছেন । আমার মাতামহ ১৯৫২ সালের ভাষাসৈনিক তথা ১৯৭১ সালের বুদ্ধিজীবী মুহাম্মদ জিয়াদ আলী রাজশাহীতে পদ্মা নদীর নিকটে শাহ মখদুম দরগার পাশে বাস করতেন। তিনি বলেছেন মুজিব আমলে বাংলাদেশ পানির ন্যায্য হিস্যা পেত, প্রমত্তা পদ্মার ঢেউয়ের কলকল শব্দ সেই বাসা থেকে স্পষ্ট শোনা যেত। পানি প্রাপ্তির সমস্যা সৃষ্টি হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকে যখন ভারতবিরোধী ও ধর্মপন্থী সরকারেরা ভারতের সঙ্গে ক্রমাগত বৈরী আচরণ করা শুরু করেন, সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেন এবং পরিণতিতে খুব্ধ ভারতও একই ধরনের পাল্টা মনোভাব দেখায়। আইয়ুব খান আমলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের এক বছর আগে ভাসানী পাকিস্তানের স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির পন্থা অনুসরণ করে আইয়ুব খানের হাতকে শক্তিশালী করার প্রস্তাব দেন। ভাসানীর মধ্যে আসলে নীতি বলে কিছু ছিলোনা, একবার সামরিক শাসনের পক্ষে গেছেন, একবার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এসেছেন, একবার ভারতের সঙ্গে কনফেডারেশনের জন্য রত হয়েছেন, আবার খুনী সরকারকে সমর্থন দিয়েছেন। তিনি নীতিহীনভাবে বিভিন্ন মতাদর্শের জগাখিচুড়ি পাকিয়েছেন !

১৯৭১ সালে পাকিস্তানী আর্মি বাঙালিদের উপর ঝাপিয়ে পড়লে ভাসানী ভারতে চলে যান এবং ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন

ভারতই যে বাংলাদেশের প্রকৃত বন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে ভারত তার প্রমাণ দিয়েছে। আমি তা কখনো ভুলতে পারিনা

সেই ব্যক্তিই আবার কদিন পর বলতে শুরু করেন

ভারতে থাকাকালীন সময়ে তিনি একপ্রকার বন্দীই ছিলেন। বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য তিনি প্রত্যেকদিন পূর্ব পুরুষের বসতবাড়ি দেখতে আসা হাজার হাজার ভারতীয়দের দোষারোপ করেন।

তিনি প্রশ্ন করেন

তারা যদি দেশকে এতোই ভালবাসে, তবে তারা এদেশে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেনা কেন

তিনি সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশ ও ভারতকে হতবুদ্ধি করে সম্পর্ক অবনতি করার অপচেষ্টায় বাংলাদেশ, আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার সমন্বয়ে বৃহত্তর বাংলার অভিপ্রায়কে পুনরুজ্জীবিত করার প্রয়াস চালান। পাকিস্তানের সাথে আসাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আগেও পাকিস্তান আমলেও তিনি দাবী করেছিলেন। এর দুবছর আগে একই ধরনের অভিপ্রায়কে তিনি সিআইএ-র ষড়যন্ত্র বলে উল্লেখ করেন।

জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে চীন ১৯৭২ সালের ২১শে আগস্ট ভেটো দেয়, ভাসানী বলেন

আমি কঠিন ভাষায় চীনের ভেটোর বিরুদ্ধে প্রচণ্ডভাবে প্রতিবাদ করছি

কিন্তু তার প্রতিবাদে না আছে প্রচণ্ডতা আর না আছে কঠিন ভাষা, এবং তার বিহ্বলতা সবই দুদিনের স্থায়ী মানসিক বিকার।
এর চারদিন পর ২৫শে আগস্ট অকৃতজ্ঞ ভাসানী ভারতকে বাংলাদেশের ১ নং শত্রু হিসেবে আখ্যা দেন এবং বলেন

সংক্ষিপ্ত অবস্থানের জন্য প্রত্যেকদিন প্রায় ৩০ লক্ষ ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে ঢুকছে । এ ধরনের চলাচল দেশের অপর্যাপ্ত সংস্থানে দুঃসহ বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে এবং দেশে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের বিস্ময়কর মূল্যবৃদ্ধির পশ্চাতে প্রধান কারণ এটিই

একদিনে ৩০ লক্ষ সফরকারী। তারা ভ্রমণ করছে কিভাবে ? কোন ভারতীয়ের বাংলাদেশ ভ্রমণের জন্য তার পাসপোর্টে ঐ দেশের বিশেষ অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। আর ভারতে কি যুদ্ধ লেগেছিলো নাকি যে প্রতিদিন ৩০ লক্ষ ব্যক্তি বাংলাদেশের মত যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে মরতে আসবে ? ভাসানী বাংলাদেশে ভারত বিদ্বেষের পথিকৃৎ, তার হীন উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তিনি কোনরকম লজ্জা বা বিবেকের তাড়না ছাড়াই বিভিন্ন বিষয়ে এরকম উদ্ভট ও মাত্রাতিরিক্ত/অতিরঞ্জিত সংখ্যা উদ্ধৃত করতেন। তিনি সরকারের সংবিধান প্রণয়নের অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তিনি ইসলামী নীতির ভিত্তিতে সংবিধান এবং ইসলামী শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপের দাবী জানান এবং তার ভেতরের গোপন বাসনা মোতাবেক বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র বানানোর পায়তারা শুরু করেন।

সাম্প্রদায়িকতার নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত ভাসানী ধর্মভিন্নতার সেন্টিমেন্টকে ইস্যু করে ভারতের বিপক্ষে জনগণকে খেপিয়ে তোলা ও উস্কে দেওয়ার জন্য বলেন ভারত বাংলাদেশকে বাজে পণ্যের আবর্জনা স্তূপের মাঠ বানিয়েছে। ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহবান জানিয়ে তিনি ভারতকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার হুমকি প্রদান করেন, বাংলাদেশের মানুষের মনে ভারতবিদ্বেষের সুড়সুড়ি দেওয়ার জন্য বলেন

বাংলাদেশ ভারতের ভিয়েতনাম হবে

তিনি সতর্ক করে দেন

বাংলাদেশ যতদিন পর্যন্ত ভারতীয় কর্তৃত্ব থেকে নিজেকে মুক্ত না করবে, ততদিন পর্যন্ত চীন বাংলাদেশের জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নে ভেটো দেবে

তিনি নিশ্চিত ছিলেন, মুজিব তার সঙ্গে বেইজিংয়ে গেলে তিনি বাংলাদেশকে চীনের স্বীকৃতি আনিয়ে দিতে পারবেন।

সৌজন্যতাহীন ও ভদ্রতাহীনভাবে দুমদাম উল্টোপাল্টা মন্তব্য করতে জুড়ি নেই যার, তিনি ভাসানী। মধ্য ৫০এর দশকে একবার আকস্মিকভাবে এক জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে তিনি বলেন

আপনি মারা গেলে ন্যূনতম ৫০০ লোক খুশী হবে

কিংকর্তব্যবিমুঢ় ম্যাজিস্ট্রেট বলেন

আমি কি করেছি

উত্তরে ভাসানী বললেন

কিছুই না। আপনি একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। সেটাই যথেষ্ট

প্রমাণ ছাড়াই এভাবে অভিযুক্ত করা কতটা যুক্তিযুক্ত বা ভদ্রোচিত ?

এই মওলানা ভাসানী ভারতের সঙ্গে কনফেডারেশন গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলো কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি হওয়ার কারণে তিনি চরম ভারতবিদ্বেষী হিসেবে পুনঃরাবির্ভূত হনইন্দিরা গান্ধীকে লেখা তার চিঠির অংশবিশেষ

১ম চিঠি

আমার শেষ সংগ্রাম বাংলাদেশকে স্বাধীন করা, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, ভারতের সহিত কনফেডারেশন। এই তিন কাজের সাধন ইনশাল্লাহ আমার জীবিতকালে দেখার প্রবল ইচ্ছা অন্তরে পোষন করি।

বাধা যতই আসুক, আমার আন্তরিক আশা ও বিশ্বাস আপনাদের আশীর্বাদে অবশ্যই পূর্ণ হইবে। আমার আন্তরিক আশীর্বাদ আপনার আদর্শানুযায়ী সমাজতন্ত্র শুধু ভারতে নহে এশিয়া আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় অবশ্যই প্রতিষ্ঠিত হইবে। যখন দরকার মনে করেন দিল্লীতে ডাকাইলেই হাজির হইব।

২য় চিঠি

আমি আপনাকে নিশ্চয়তা দিতে পারি যে, বাংলাদেশে স্বাধীনতা অর্জন এবং ভারতের সাথে স্বাধীন বাংলাদেশের কনফেডারেশন গঠন করার লক্ষ্যে আমি আমার সংগ্রাম অক্ষুন্ন রাখব।যেই আমাকে প্রো-চাইনিজ বলে আপনার কাছে চিহ্নিত করতে অপচেষ্টা করুন, ইনশাল্লাহ আমি ভারত ও আপনার অবাধ্য হবো না।

সূত্রঃ

সৈয়দ আবুল মকসুদ : মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (পৃষ্ঠা ৪৬১-৪৬২)

সিরাজউদ্দিন আহমদ, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ (পৃ.৩৬১-৩৬২)

শেষোক্ত বইয়ে সেখানে ভাসানীকে নিয়ে একটি চ্যাপ্টার আছে যেখানে তার পিএস সাইফুল ইসলামের জবানীতে বলা হয়েছে :

মওলানা সাহেবের নিজ হাতে লেখা এই খসড়া বার বার পড়লাম। এই মুহূর্তে মওলানা ভাসানীকে রহস্যময় মনে হলো। রাণীক্ষেতে তিনি নিজ হাতে এই ধরণের আর একটি খসড়া দাঁড় করিয়ে আমাকে দিয়েছিলেন অনুবাদ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী বরাবর পাঠিয়ে দিতে। আসামেও আমাকে দিয়ে এ ধরণের একটি খসড়া দাড় করিয়েছিলেন। রাণীক্ষেত ও আসামের খসড়ায় তিনি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে এ নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন, তাকে আসামে থাকতে দিলে তিনি আসাম ও ভারতের আভ্যন্তরীন রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাবেন না এবং ভারত সরকারকে তার খরচ বহন করতে হবে না। অবশ্য এ দুটো চিঠিতে ভারতের সাথে বাংলাদেশের কনফেডারেশনের কথা উল্লেখ করেছিলেন।

আর্মির পাকিস্তানপন্থী ব্লকের আধিপত্য এবং কে এম শফিউল্লাহর দুর্বল ভূমিকা

১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট এর আগে ও পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ঘটতে থাকা ঘটনাবলী নিয়ে বলেছেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল (অবঃ)কে এম শফিউল্লাহ, বীর উত্তম।সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ইনাম আহমেদ এবং জুলফিকার আলী মানিক, এর অংশবিশেষ উল্লেখিত হলোঃ

একটি লম্বা এবং ক্লান্তিকর দিন শেষে শফিউল্লাহ যখন বিছানায় যান তখন রাত প্রায় দেড়টা।প্রায় ফজরের নামাজের সময় তার ভৃত্য তাকে জাগিয়ে তোলে এবং তিনি দেখতে পান যে তখনকার মিলিটারী ইন্টেলিজেন্স এর ডিরেক্টর কর্ণেল সালাউদ্দিন তার কক্ষের দরজার বাইরে দাড়িয়ে আছেন।তিনি শফিউল্লাহকে জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি আর্মার্ড এবং আর্টিলারী ডিভিশনকে শহরের দিকে পাঠিয়েছো’?শফিউল্লাহ টের পান তার মেরদন্ড বেয়ে একটি ঠান্ডা হিমস্রোত বেয়ে যাচ্ছে।তিনি উত্তর দেন না তো। কেনো?’

সালাউদ্দিন উত্তর দেন, ‘আর্মার্ড ডিভিশন এবং আর্টিলারী ডিভিশন রেডিও ষ্টেশন, গণভবন এবং বঙ্গবন্ধুর ধনামন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ীর দিকে এগুচ্ছে।
শফিউল্লাহ জিজ্ঞেস করেন, “ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার এব্যাপারটি জানে’? সে সময ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন কর্ণেল শাফায়াত জামিল।
শাফায়াত জামিল বলেন,‘আমি জানিনা।আমি আপনার কাছেই প্রথম এসেছি।
যাও শাফায়াত জামিলকে বলো এক, দুই এবং চার নম্বর ব্যাটালিয়নকে পাঠিয়ে আর্টিলারী এবং আর্মার্ড বাহিনীর অগ্রসর হওয়া বন্ধ করতে।এ নির্দেশ এর সাথে শফিউল্লাহ এও বলেন যে তিনি নিজেও দ্রুত শাফায়াত জামিলকে ফোন করতে যাচ্ছেন।এখানে বলে রাখা ভালো যে, আর্মিতে চীফ অফ ষ্টাফ সমগ্র আর্মিকে পরিচালিত করে আর ট্রুপগুলো পরিচালিত হয় ব্রিগেড কমান্ডারদের নির্দেশে ।

শফিউল্লাহ তখন লাল টেলিফোনটি তুলেন শেখ মুজিবকে সতর্ক করার জন্য।কিন্তু ফোন লাইনটি ব্যস্ত ছিলো।তখন তিনি শাফায়াত জামিলকে ফোন করেন এবং এ লাইনটিও ব্যস্ত পান।এরপর তিনি কর্ণেল জামিলউদ্দিন আহমেদকে ফোন করেন।কর্ণেল জামিল তখন সদ্য প্রেসিডেন্টের মিলিটারী সেক্রেটারী পদ থেকে ডিএফআইতে বদলী হয়েছেন।ফোনে শফিউল্লাহকে জামিল বলেন যে, বঙ্গবন্ধু তাকে ফোন করেছিলেন এবং তাকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যেতে বলেছেন কারন সেখানে কিছু লোক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে।শফিউল্লাহ জামিলকে বলেন বঙ্গবন্ধুকে অন্য কোথাও স্থানান্তর করার জন্য।জামিল পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যাওয়ার পথে সোবাহানবাগ মসজিদের সামনে বিদ্রোহী আর্মি অফিসারদের হাতে নিহত হন।

শফিউল্লাহ যখন কর্ণেল শাফায়াত জামিলকে ফোনে পান তখন প্রায় ভোর সাড়ে পাঁচটা।তুমি কি জানো, আর্টিলারী এবং আর্মার্ড সেনারা কেনো শহরের দিকে যাচ্ছে?’ তিনি শাফায়াতকে জিজ্ঞেস করেন।
না

আমি তাকে বলি যে, সালাউদ্দিন আমাকে এ ব্যাপারে জানিয়েছে, এবং তাকে আমি তৎক্ষনাত তার অধীনস্থ এক, দুই ও চার নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পাঠিয়ে অগ্রসররত সেনাদের থামানোর ও ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দেই।

শফিউল্লাহ এয়ার ফোর্স এবং নৌবাহিনীর প্রধানদের সাথেও এ ব্যাপারে কথা বলেন এবং তারাও তাকে অবহিত করেন যে এ ব্যাপারে তারা কিছু জানেননা।এর কিছুক্ষণ পরে তিনি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সাথে কথা বলেন এবং তারাও এব্যাপারে তাদের অজ্ঞতার কথা জানান।

তিনি যখন জিয়াকে সেনাদের শহরের দিকে অগ্রসরতার কথা জানান, জিয়া প্রতিউত্তরে বলেছিলেন, ‘তাই না কি?’ এর থেকেই তিনি ধরে নেন জিয়া ব্যাপারটি সম্পর্কে কিছু জানতেননা। এরপর তিনি খালেদ মোশাররফ এবং জিয়া উভয়কেই যতদ্রুত সম্ভব তার বাসভবনে আসতে বলেন।

তারা দুজনেই ১৫ থেকে ২০ মিনিটের মধ্যে উপস্থিত হন। খালেদ তার নিজস্ব গাড়ি চালিয়ে আসেন, পরনে ছিলো স্লিপিং গাউন। জিয়া এসেছিলেন তার অফিসের গাড়ি করে, শেভ করা এবং সেই সাত সকালেও ইউনিফর্ম পরিহিত।

খালেদ এবং জিয়া তার বাড়ী পেৌঁছানোর আগে তিনি আরেকবার প্রেসিডেন্ট এর বাড়ীতে ফোন করেন এবং এবার তিনি বঙ্গবন্ধুকে ফোনে পান।
শফিউল্লাহ বলেন, ‘যখন ডিএমআই (সম্ভবত ডিএফআই হবে, মূল অংশে ডিএমআই আছে) আমাকে সেনাদের শহরের দিকে অগ্রসর হওয়া সম্পর্কে অবহিত করে সেটা ছিলো সোয়া পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে এবং শাফায়াত জামিলের সঙ্গে আমি কথা বলি সাড়ে পাঁচটা থেকে পাঁচটা পঁয়ত্রিশ এর মধ্যে।আমি যখন বঙ্গবন্ধুকে প্রথমবার ফোন করি তার বিশ থেকে পচিঁশ মিনিট পর আমি তাকে ফোনে পাই।সময়টা আমার ঠিক মনে নেই তবে তা অবশ্যই সকাল ছয়টার আগে।
তোমার বাহিনী আমার বাসায় আক্রমণ করেছে।তারা হয়তো কামালকে [বঙ্গবন্ধুর ছেলে] হত্যা করতে পারে।এক্ষুনি তোমার বাহিনী পাঠাও
বঙ্গবন্ধু রাগত কন্ঠে বলেন শফিউল্লাহকে।
শফিউল্লাহ বলেন, ‘স্যার আমি কিছু একটা করার চেষ্টা করছি।আপনি কি কোন ভাবে বাড়ী থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করতে পারেন?’
ও পাশ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে আমি হ্যালো বলতে থাকি এবং এক মিনিট পরেই আমি গুলির শব্দ পাই এবং তার কয়েক মিনিট পরেই ফোন লাইনটি ডেড হয়ে যায়।
এরপর খালেদ মোশাররফ এবং জিয়াকে সহ শফিউল্লাহ তার অফিসের উদ্দেশ্যে বাড়ী থেকে বের হন।এর মধ্যে দশ থেকে পনেরো মিনিট হয়ে গিয়েছে শফিউল্লাহ কথা বলেছেন কর্ণেল শাফায়াত জামিলের সাথে কিন্তু তখন পর্যন্ত সেনাদের অগ্রসরতা থামেনি।

শফিউল্লাহ ছেচল্লিশ নম্বর ব্রিগেডকে পরিচালিত করার জন্য খালেদ মোশাররফকে নির্দেশ দেন এবং তাকে রিপোর্ট করতে বলেন।
নাসিম, জিয়া এবং খালেদ মোশাররফ সহ শফিউল্লাহ তার অফিসে বসে ছিলেন এবং তাদের মাধ্যমে তিনি জানতে পারেন যে একটি ট্যাংক তাদের অফিসের কাছে অবস্থান নিয়েছে।
এর কিছুক্ষণ পরেই দুতিনটি গাড়ি তার অফিস চত্বরে আসে এবং মেজর শরীফুল হক ডালিম পনেরো-ষোল জন সৈন্য সহ তার অফিসে প্রবেশ করে।ডালিম তার কিছুদিন আগে চাকুরীচ্যুত হন।
চীফ কোথায়?’ শফিউল্লাহর কক্ষে প্রবেশ করতে করতে ডালিম জিজ্ঞাসা করেন।
ডালিম এবং তার সৈন্যদের অস্ত্র শফিউল্লাহর দিকে তাক্ করা ছিলো।
শফিউল্লাহ ডালিমকে বলেন, ‘অস্ত্র দেখে এবং ব্যবহার করে আমি অভ্যস্ত।যদি তোমরা অস্ত্র ব্যবহারের উদ্দেশ্যে এসে থাকো তবে ব্যবহার করো।আর যদি কথা বলতে চাও তবে অস্ত্র বাহিরে রেখে এসো।
ডালিম অস্ত্র নীচু করে বললেন, ‘প্রেসিডেন্ট আপনাকে এক্ষণি রেডিও ষ্টেশনে যেতে বলেছেন।
উত্তেজনাকর কিছু মুহুর্ত পার হওয়ার পর শফিউল্লাহ বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট? আমি যতদূর জানি প্রেসিডেন্ট মারা গিয়েছেন।যখন শফিউল্লাহ তার অফিসে পৌছান, তার এডিসি ক্যাপ্টেন কবির তাকে জানান যে প্রেসিডেন্ট মারা গিয়েছেন।
ডালিম গর্জে উঠে বলেন, ‘আপনার জানা উচিত যে খন্দকার মোশতাক এখন প্রেসিডেন্ট।
শফিউল্লাহ বলেন খন্দকার মোশতাক আপনার প্রেসিডেন্ট হতে পারে, আমার নয়

ডালিম বললেন, ‘আমাকে এমন কিছু করতে বাধ্য করবেননা যা আমি এখানে করতে আসিনি।
শফিউল্লাহ উত্তর দেন, ‘তোমার যা ইচ্ছা তুমি করতে পারো, আমি তোমার সাথে কোথাও যাচ্ছিনা।

শফিউল্লাহকে ইসলামীব্লকপন্থী জিয়াউর রহমান এবং মুজিববিরোধী মেজর ডালিম উভয়ে হাইজ্যাক করে

শফিউল্লাহ এরপর তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান এবং ডালিম্ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের ভেতর দিয়ে সোজা ছেচল্লিশ নম্বর ব্রিগেডে যান।কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে তিনি দেখতে পান ব্রিগেডের সকল সৈন্য এবং তাদের সকল অফিসারেরা চক্রান্তকারীদের সাথে যোগ দিয়েছে।সেখানে তিনি মেজর খন্দকার আব্দুর রশীদ এবং ৪৬ নম্বর ব্রিগেডের তৎকালীন মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ এর দেখা পান।তারা তাকে বারংবার রেডিও ষ্টেশনে যাবার তাগিদ দিচ্ছিলো।শফিউল্লাহ তাদের বলেন যে তিনি একা রেডিও ষ্টেশনে যাবেননা।

পুরো সময়টা ধরে শফিউল্লাহ ভাবছিলেন।এটা তার কাছে পরিষ্কার ছিলো যে, সেনাবহিনীর বড় অংশটিই বিদ্রোহীদের সাথে যোগ দিয়েছে।যেহেতু কেউ তার নির্দেশ মানছিলোনা সেহেতু সে সময় কিছু করার চেষ্টা করতে যাওয়াটা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতো।শফিউল্লাহ স্বগোক্তি করেন, ‘আমাকে আগে আমার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে

পরে বিদ্রোহীরা নৌবাহিনীর প্রধান রিয়ার এ্যাডমিরাল এমএইচ খান এবং বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার সহ তিন প্রধানদের নিয়ে রেডিও ষ্টেশনে যায়।সেখানে শফিউল্লাহ দেখতে পান খন্দকার মোশতাক একটি কক্ষে বসে আছেন সাথে তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর।

শফিউল্লাহকে দেখার সাথে সাথে মুশতাক আন্দোলিত কন্ঠে বলেন, ‘শফিউল্লাহ, অভিনন্দন!তোমার সেনারা খুব ভালো কাজ করেছে। এখন বাকীটা সেরে ফেলো।
সেটা কি?’ শফিউল্লাহ প্রশ্ন করেন।
সেটা আমার থেকে তুমি ভালো জানো’, মুশতাক উত্তর দেন।
সে ক্ষেত্রে এটা আমার উপর ছেড়ে দিন
শফিউল্লাহ দ্রুত উত্তর দেন এবং কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন।
তখন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর মুশতাককে বলেন, ‘ওনাকে যেতে দেবেননা।ওনার সঙ্গে আমাদের এখনও কিছু কাজ বাকী আছে

শফিউল্লাহ যখন বেরিয়ে আসছিলেন তখন তিনি দেখতে পান ডালিম এবং রশীদ সৈন্য নিয়ে দাড়িয়ে আছে এবং তারা তিন বাহিনীর প্রধানদের আর একটি কক্ষে নিয়ে আসে।

এর কিছুক্ষণ পর তাহেরউদ্দিন ঠাকুর কক্ষটিতে প্রবেশ করে এবং শফিউল্লাহকে খন্দকার মুশতাক এর সমর্থনে একটি লিখিত বক্তব্য জোরে পাঠ করতে বলে।কথামতো শফিউল্লাহ তাই করেন এবং বক্তব্যটি রেকর্ড করা হয়।রেকর্ড শেষ হয়ে গেলে মুশতাক ঘোষণা করেন, ‘আমি তিন বাহিনীর প্রধানদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত দেখতে চাই

মুজিব হত্যার সঙ্গে বাকশালের সংশ্লিষ্টতা

বাকশাল = বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক লীগ অর্থাৎ এটিই প্রকৃতপক্ষে জনগণের দল, দেশের সেসময়ের ৮৫% কৃষক শ্রমিকের দল। তাদের দারিদ্র বিমোচনের লক্ষ্যেই তাদের প্রাধান্য দিয়ে এই দল গঠন করা হয়েছিলো। বাকশাল ছিলো ২য় বিপ্লব । বাকশাল ছিলো সশস্ত্র বাহিনী চরমপন্থী বামদল এবং বিত্তবান সমাজের বিরুদ্ধে এক মহাপ্রতিবাদ। বাকশাল প্রতিষ্ঠায় এই সংখ্যালঘু শ্রেণী অর্থাৎ ১৫% আর্মি/বিত্তবান/শহুরে জনগোষ্ঠীর স্বার্থ বিনষ্ট হয়। তাই তারা ক্ষেপে ওঠে, তাদের প্রতিক্রিয়াশীলতার মাধ্যমে তারা দেশের নবজাগরণকে ব্যহত করার জন্য বাকশালের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অপপ্রচার চালায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। বাংলাদেশের আর্মির অনেক সদস্য যারা একসময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্য ছিলো, তারা বাকশাল পছন্দ করেনি। কারণ এতে আর্মিদের প্রতি সরকারী ব্যয় কমে যেত এবং সাধারণ মানুষের ওপর সরকারী ব্যয় বৃদ্ধি পেত। ফলে, ফ্রি ফ্রি খাওয়াদাওয়া, সুযোগ সুবিধা নেওয়া এবং গলফ খেলা বিলিয়ার্ড খেলা টেনিস খেলা বের হয়ে যেত ! বাকশাল ছিলো সুবিধাবঞ্চিত জনগণের অবস্থা উন্নতির জন্য গঠিত দল। ডঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল বাকশাল সম্পর্কে বলেন চিত্রটি দেখুন ( মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বই থেকে গৃহীত )

অর্থাৎ বাকশাল একটি গ্রহণযোগ্য বিষয় ছিলো সকলের কাছে এবং দেশের অরাজকতা নিরসনের জন্য তথা সামরিক খাতে খরচ হ্রাস করে গরীব মানুষের অবস্থার উন্নতি করার লক্ষ্যেই বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। সেটাকেই স্বার্থবাদী সশস্ত্র বাহিনী এবং মুনাভালোভী ব্যবসায়ী ও বিত্তবান শ্রেণী রোখার জন্য বাকশালের বিরুদ্ধে ঢালাওভাবে প্রোপাগান্ডা চালায়।

অর্থাৎ, স্বার্থে আঘাত লাগা থেকেই সশস্ত্র বাহিনী ও সুবিধাবাদীদের বাকশাল নিয়ে গোয়েবলসীয় অপপ্রচার এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ । বিস্তারিত জানতে অমি রহমান পিয়ালের দ্বিতীয় বিপ্লব বা বাকশাল : শুনুন বঙ্গবন্ধুর মুখেই -পড়ে দেখুন।

বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে (১৯২০-১৯৭৫) স্বদেশের মাটি আর মানুষকে এমন গভীর মায়া মমতা ও ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধেছিলেন,যে বন্ধন কোনোদিন ছিন্ন হবার নয়। আজীবন পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে,দরিদ্র নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে এমন অনন্য সংগ্রামী ভূমিকা রেখেছিলেন,যার নজির ইতিহাসে বিরল। মাত্র ৫৫ বছরের ক্ষুদ্র জীবনে ২৯ বার জেলে গিয়েছিলেন তিনি,এই বাংলা এবং বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য। জীবনের অনেকগুলো মূল্যবান বছর কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে কাটিয়েছেন যিনি দেশ আর মানুষের মুক্তির জন্য, সেই প্রিয় স্বদেশের মানুষ যে তাকে এভাবে নৃশংসভাবে হত্যা করতে পারে,এ ছিল তাঁর কল্পনারও অতীত। এমন সিংহহৃদয় অবিসংবাদী মহান নেতাকে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী পর্যন্ত গুলি করে মারার সাহস পায়নি, ফাঁসি দেওয়ার পরিকল্পনা করেও ফাঁসি দিতে পারেনি। আর সেই মহান পুরুষকে কিনা মারলো তাঁরই প্রাণপ্রিয় বাংলাদেশের কতিপয় ব্যক্তি ? জাতি হিসেবে বাঙালি জাতি যে কতটা সুবিধাবাদী স্বার্থপর ও সুযোগসন্ধানী হিংস্র নৃশংস এবং অকৃতজ্ঞ -কৃতঘ্ন, তার প্রমাণ এখানেই । নরপশু ঘাতকদের ২ জন এবং ষড়যন্ত্রকারীদের অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাও ছিলো, এই কি মুক্তিযোদ্ধাদের নমুনা ? আজকে অনেক মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানপন্থী জামায়াতে ইসলামের সঙ্গে জোট করা বিএনপির নেতা কর্মী ও সমর্থক। মুক্তিযোদ্ধারা যদি বাংলাদেশের পক্ষে হয়, ঘাতক নরপশু ও ষড়যন্ত্রকারীরা যদি মুক্তিযোদ্ধা হয়, তবে কি করে তারা বাংলাদেশের মহাস্থপতিকে ও মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করতে পারে ? কি করে আজকে অগণিত মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার জামাতের দোসর বিএনপিকে সমর্থন করতে পারে ? এজন্যই প্রাজ্ঞ ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন বলেন

একবার যে রাজাকার, সব সময়ই সে রাজাকার। কিন্তু একবার যে মুক্তিযোদ্ধা, সবসময় সে মুক্তিযোদ্ধা না-ও থাকতে পারে।

মুজিব হত্যাকাণ্ডে বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদে বেড়িয়েছে ১৯৭৫-২০১০ এর ২৬শে জানুয়ারী পর্যন্ত । অবশেষে দীর্ঘ ৩৪ বছর পর ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি মধ্যরাতে জাতি কিছুটা কলঙ্কমুক্ত হলো।

রাত ১ টার মধ্যে কার্যকর হয়ে গেল ৫ খুনির মৃত্যুদণ্ডাদেশ । ওদের ফাঁসির পরে যখন কফিন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো তখন দেখা গেল হাজার হাজার মানুষ সেই কফিনে থুতু এবং জুতা নিক্ষেপ করছে। এগুলো ছিলো জনগণের চরম কষ্ট ও যন্ত্রণার বঃহিপ্রকাশ। সেদিন প্রায় সারারাত জেগেছিল বাংলাদেশ। পরের দিন ২৮ শে জানুয়ারি গোটা দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। কিন্তু জাতি পুরোপুরি কলঙ্কমুক্ত হয়নি আজও।

বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার পরিজনের হত্যাকারী পলাতক আরো ৬ খুনী লে. ক. (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশীদ,মেজর (বরখাস্ত) শরীফুল ইসলাম ডালিম,মেজর (অব.) নূর চৌধুরী,রিসালদার মোসলেহউদ্দিন,লে. ক. (অব.) রাশেদ চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন (অব.) মাজেদকে এখনো পালিয়ে রয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। যতদিন পর্যন্ত ঐ নরপশুদের ফাঁসির দড়িতে ঝোলানো না যাচ্ছে ততদিন পর্যন্ত জাতি পুরোপুরি কলঙ্কমুক্ত হতে পারবেনা।

শফিক আলম মেহেদী কথায় নাসির খানের সুরে এবং গাজী মিজানের কণ্ঠে গাওয়া তিনি কি আসবেনগানটিই হোক আমাদের আশা ভরসা -

তিনি কি আসবেন/তিনি কি আসবেন/তিনি কি আসবেন/আবার আসবেন/যিনি চোখ তুলে তাকালে রোদ উঠতো ফুল ফুটতো পাখি ডাকতো/সাম্য স্বদেশ স্বাধীনতা করে করে/ আমলা হবার বাসনা গৃহের নিবিড় সুখ জলাঞ্জলি দিলেন/সুনিপুণ স্থপতির মত মুক্ত স্বদেশ নির্মেঘ নীল আকাশ রেখে গেলেন/উত্তরসূরীদের অনায়াস অধিকারে/তিনি কি আসবেন/তিনি কি আসবেন/তিনি কি আসবেন/আবার আসবেন/বাংলার ঘরে ঘরে/অগণন সূর্যোদয়ের স্বপ্নিল প্রত্যাশায়/যৌবনের অনিন্দ্যসুন্দর অনেকগুলো বছর কারাবাসে কাটালেন যিনি আরণ্যক অন্ধকারে/তিনি কি আসবেন/তিনি কি আসবেন/তিনি কি আসবেন/আবার আসবেন/হ্যামিলনের আশ্চর্য বাঁশিওয়ালার মতন/বুনো হাওয়ায় যে কন্ঠ ভেসে এলে ঘর গৃহস্থালি বনবাদাড় উজাড় করে/ ছুটো যেত অযুত লক্ষ মানুষ/পল্টনে- রেসকোর্সে স্বপ্নের ঘোরে/ তিনি কি আসবেন/তিনি কি আসবেন/তিনি কি আসবেন/আবার আসবেন/যাকে দেখে পদ্মা মেঘনার উত্তাল তরঙ্গরাশি নত হতো বিপুল কুর্নিশে/ তিনি কি আসবেন/তিনি কি আসবেন/তিনি কি আসবেন/আবার আসবেন/আমাদের মাঝে পতিত পৃথিবীতে যার মুখ চেয়ে সন্তানপ্রতিম বাঙালি আমরা অনন্ত প্রার্থনার সুরে বলবো হে জনক হে ঋষি এধুলো এ মাটি স্পর্শ করে দাও/ সোনা হোক সোনা হোক সোনা হোক খাটি সোনা খাটি সোনা খাটি সোনা।

সূত্র :

১) কারা মুজিবের হত্যাকারী এ এল খতিব (Who Killed Mujib – A L Khatib )
২) তিনটি সেনা অভ্যুথান ও কিছু না বলা কথা,লে কর্নেল এম এ হামিদ,মোহনা প্রকাশনী,১৯৯৫
৩) একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্যআগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর,কর্নেল শাফায়াত জামিল,সাহিত্য প্রকাশ , এপ্রিল ২০০০
৪) বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড:ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস,অধ্যাপক আবু সাইয়িদ
৫) ভোরের হত্যাযজ্ঞ (ভোরের কাগজ:১৫ আগস্ট,২০০৫)
৬) পচাত্তরের পনেরই আগষ্ট,মেজর মো মুখলেছুর রহমান,আহমদ পাবলিশিং হাউজ,ঢাকা ১৯৯৬

৭) মুজিব হত্যায় সি আই এ,দেলোয়ার হোসেন,এশিয়া পাবলিকেশন,ঢাকা ১৯৯৬

৮) ক্রাচের কর্ণেল শাহাদুজ্জামান

৯) ভোরের কাগজ,১৫ আগষ্ট ১৯৯৩

১০) বাংলাবার্তা,১২ আগষ্ট ১৯৮৮

১১) সমকাল ১৩-১৪ আগষ্ট ২০০৮

১২) মিজানুর রহমান চৌধুরী,রাজনীতির তিনকাল

১৩) সৈয়দ আবুল মকসুদ : মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী

১৪) সিরাজউদ্দিন আহমদ, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ

বিভিন্ন কলাম

১) সে রাতের হত্যাকাণ্ড কাজী আব্দুল হান্নান

২) জিয়ার পক্ষে ফারুক-রশীদ অস্ত্র কিনতে মার্কিন দূতাবাসে যান মিজানুর রহমান খান

৩) অভ্যুত্থানকারীরা মুজিবকে হত্যার চেয়ে বেশি কিছু ভাবেনি’- মিজানুর রহমান খান

৪) যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ রাখছিলেন কারা?’ – মিজানুর রহমান খান

৫) ইতিহাসের কাছে এ আমার দায় : আবেদ খান

৬) শোকাবহ আগস্ট: আমব্রিখটের চিঠি

৭) নতুন ষড়যন্ত্রের মুখে বাংলাদেশ, এবার টার্গেট শেখ হাসিনা মিনা ফারাহ

৮) জিয়া সম্পর্কে প্রিয় সাইটের একটি রিপোর্ট

৯) অধিকাংশ দিন আত্মগোপনে থাকতাম: বাদী কামরুল ইসলাম

১০) ১৫ই আগস্ট আরো নিহত হন যারা বিডিনিউজ২৪

ইংরেজী গ্রন্থ

1. Additioinal Paper Books of Death Reference No. 30 of 1998 (Arising out of Sessions Case No. 319 of 1997)Judgement Passed by Mr. Kazi Golam Rasul District & Sessions Judge, Dhaka.

2. Bangladesh: A Legacy of Blood, by Anthony Mascarenhas, Hodder and Stoughton, 1986

3. Memoir written in 2005 by Lawrence Lifschultz

4.Bangladesh: The Unfinished Revolution by Lawrence Lifschultz, London: Zed Press, 1979

5. World in Action , ITV , Granda Television , August 1976

6. God willing: the politics of Islamism in Bangladesh ( By Ali Riaz)

7. Anatomy of a Coup: A Journey of a Quarter Century (Lawrence Lifschultz)

http://warcriminalsinbangladesh.wordpress.com

http://warcriminalsinbangladesh.blogspot.com

http://warcriminalnizami.blogspot.com

http://warcriminalsakachoudhury.blogspot.com

http://godfathertareqzia.blogspot.com

http://razakarnizami.blogspot.com

http://freedomfighters71.blogspot.com

http://muktimusician.picturepush.com

http://community.webshots.com/user/muktimusician

http://barristertaposhfanclub.blogspot.com

www.myspace.com/muktimusician

www.orkut.com/warcriminalsinbangladesh

www.warcriminalsinbangladesh.hi5.com

www.facebook.com/muktimusician

www.picasaweb.com/muktimusician

www.orkut.com/muktimusician

www.muktimusician.hi5.com

www.youtube.com/deshnetree

www.youtube.com/muktisena71

www.youtube.com/nizami71

www.tagged.com/amibangali

www.tagged.com/muktimusician

www.tagged.com/deshratna

www.youtube.com/muktimusician

www.shtyle.fmm/muktimusician

www.facebook.com/muktimusician

www.orkut.com/muktimusician

www.quepasa.com/muktimusician

www.tagged.com/mukthimadaripuri

www.tagged.com/muktithegreat

www.tagged.com/amibangali

http://www.squidoo.com/muktimusician

http://priyo.com/muktimusician

www.tagged.com/khankirpolababar

www.bebo.com/muktimusician

www.hibuu.com/muktimusician

http://blogtown.co.nz/muktimusician/

www.twitter.com/muktimusician

www.zimbio.com/member/muktimusician

http://www.caringbridge.org/visit/muktimusician

http://en.wikipedia.org/wiki/User:Muktimusician

www.facebook.com/deshratna2009

www.facebook.com/sheikhhasinafanclub

www.facebook.com/shadhinatha

www.facebook.com/jatirjanokbangabandhu

www.facebook.com/thebrokenbackbone

www.facebook.com/proggasrijanikhelaghor

www.blogigo.co.uk/muktimusician

http://muktimusician.myblogsite.com/

http://muktishena71.bloggy.se/

www.playlist.com/muktimusician

www.last.fm/user/muktimusician

http://friendfeed.com/muktimusician

http://muktimusicina.twitpic.com/

http://www.netlog.com/muktimusician

www.dailymotion.com/muktimusician

http://www.facebook.com/sheikhrussellrahman

No comments:

Post a Comment