ইতিহাসের নৃশংসতম বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান, মওলানা ভাসানীসহ ঘাতক চক্রের ভূমিকা:
http://blog.bdnews24.com/dr_mushfique
স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতকচক্রের গুলিতে ঝাঁঝরা বঙ্গবন্ধুর সারা দেহ
আজ ইতিহাসের সেই বিভীষিকাময় শোকাবহ ১৫ আগস্ট, ‘যাঁর নামের উপর রৌদ্র ঝরে/চিরকাল গান হয়ে নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা/যাঁর নামের উপর কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া’… বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম পুরুষ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী, আজ জাতির চরম বেদনার দিন, রুধির হয়ে অশ্রু ঝরে পড়ার দিন, রাজনীতির সেই একমেবাদ্বিতীয়ম প্রবাদ পুরুষের বিয়োগব্যথায় শোকাকুল হওয়ার দিন।
"শোন একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রনি।"
অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আজকে এই শোকের দিনে আমি আমার লেখা নিয়ে হাজির হয়েছি আপনাদের নিকটে। ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড – বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমাদের দেশের তরুণ সমাজ বলতে গেলে তেমন কিছুই জানেনা। দীর্ঘ সময় দেশে পাকিস্তান প্রত্যাগত সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় ছিলো, বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের অন্যতম নায়ক জিয়াউর রহমান, পাকিস্তান প্রত্যাগত হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ এবং জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়ার কর্তৃক বাংলাদেশ অপশাসিত হওয়ার কারণে এই বিষয়টি নিয়ে তেমন লেখালেখি হয়নি, মানুষ অজ্ঞতার তিমিরেই থেকে গেছে । এমনকি আওয়ামী লীগের মধ্যেও এই বিষয় নিয়ে যতটা জনগণকে জানানোর ছিলো, ততটা জানানোর আগ্রহ তেমন লক্ষ্য করিনি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে অজ্ঞতার অবগুণ্ঠন আজকে আমি খুলে দেব বলে শপথ নিয়ে এসেছি । বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে কার কি ভূমিকা, কার কতোটা সংশ্লিষ্টতা তা নিয়ে আমার জানামতে এর চেয়ে তথ্যবহুল কোন আর্টিকেল আজ পর্যন্ত রচিত হয়নি। এরজন্য বিভিন্ন লেখক এবং লেখিকার লেখা কলাম ও গ্রন্থের সহযোগিতা নিতে হয়েছে, তাদের প্রতি আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা রইলো। যাদের নাম উল্লেখ করা হয়নি, তারা নিজগুণে ক্ষমা করে দেবেন। আসুন শুরু করা যাক ইতিহাসের সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে আমার ম্যারাথন দৌড় –
যেভাবে ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়
১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট চ্যান্সেলর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যাওয়ার কথা ছিল বঙ্গবন্ধুর । ১৪ই আগস্ট বঙ্গবন্ধু রাত সাড়ে আটটার দিকে গণভবন থেকে বাড়ি ফেরেন। ১৪ই আগস্ট রাতে কাওরান বাজারে একটি ট্যাংক দেখা যায়, পিজি হাসপাতালের সামনে আরেকটি ট্যাংক দেখা যায় । মতিঝিলের কাছে আরো একটি ট্যাংক । এক কিলোমিটারের ব্যবধানে ৩টি ট্যাংক । আবার ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটের সামনে আরেকটি ট্যাংক। সেদিন রাতে খন্দকার মোশতাক আহমেদের ৫৪ নং আগামসি লেনের বাসায় মেজর রশিদ এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের আগমন। ১৫ই আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্বর্ধনা জানানো হবে বলে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন কাজ করে মুজিবপুত্র কামাল সেদিন মধ্যরাতে বাড়ি ফেরেন। ঢাকা সেনানিবাসও ব্যস্ত, কর্নেল ফারুক বেঙ্গল ল্যান্সারের উদ্দেশ্য ভাষণে বলে – মুজিব সেনাবাহিনীদের শেষ করে দেবে এবং ল্যান্সারদের বাতিল করবে এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে বলে –
এবার আঘাত হানার সময় এসেছে
ঘাতক চক্র তিন লাইন করে বেরিয়ে পড়ে। মাত্র দুই কিলোমিটার দূরেই তাদের লক্ষ্যবস্তু । গভীর রাতে রক্ষীবাহিনী তড়িঘড়ি করে শেরেবাংলা নগরস্থ এমএনএ’র হোস্টেলের সামনে লুঙ্গী ও গেঞ্জি পরে অবস্থান নিলেও অজ্ঞাত (!) কারণবশত কিছুক্ষণ বাদেই ফেরত যায় (কার নির্দেশনায় ফিরে যায়?)। একটি ট্যাংক পুরানো এয়ারপোর্টের রানওয়ে দিয়ে এসে একটি দেওয়াল ভেঙে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পের দিকে ট্যাংকের বন্দুকের নলটি তাক করে। সে রাতে ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থানে ৩০টি ট্যাংক অবস্থান নেয়। মুজিব ও তাঁর ভগ্নীপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবত এবং ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণির বাড়ি ট্যাংক দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। সৈন্যরা চারদিক থেকে মুজিবের বাড়ির ওপর গুলি বর্ষণ করতে থাকে। একটি বুলেট মুজিবের ছোটভাই নাসেরের হাতে লাগে। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের মত এবারো বাড়ির সকলে মুজিবের শোবার ঘরে আশ্রয় নেয়, তখন ছিলো পাকিস্তানী বাহিনী আর এবার পাকিস্তানী ও ইসলামী মনোভাবাপন্ন বাঙালি আর্মির দল। মুজিব কয়েকজন অফিসারকে ফোন করেন, তাঁর স্ত্রী শাড়ির এক অংশ ছিড়ে নাসেরের রক্তাক্ত হাতে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন। কামাল ওপর থেকে নিচে নেমে এসে গার্ডদের অবস্থা নেওয়ার জন্য বলেন কিন্তু ততক্ষণে গার্ডরা নিরস্ত্র, এই মুহূর্তে মেজর হুদা কয়েকজনকে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলে গার্ডরা হুদাকে স্যালুট দেয় এবং মেজর হুদার সাথে থাকা একজন কামালকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।
মুজিবের বাড়িতে আসার সময় সোবহানবাগে অবস্থানরত সৈন্যরা বিগ্রেডিয়ার জামিলের পথরোধ করে, জামিল নিজের পরিচয় দিলেও পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক তাকে অগ্রসর হতে দেওয়া হয়নি এবং জামিল জোরপূর্বক জীপ নিয়ে এগোতে চেষ্টা করলে তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়।
এদিকে সৈন্যদের অনেকে মুজিবের বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে এবং রেহানার বন্ধ কামরায় ঢুকে জিনিসপত্র তছনছ করে।
দেখি তারা কি চায়
বলে চেক লুঙ্গী ও সাদা কুর্তা (পাঞ্জাবী) পরিহিত মুজিব নিজ কামরা থেকে বের হয়ে আসেন। সিড়িতে হুদার সঙ্গে দেখা হলে মুজিব জিজ্ঞাসা করেন
ও’তুমি, কি চাও ?
হুদা বলে –
আমরা আপনাকে নিতে এসেছি
মুজিব একটু গম্ভীর গলায় বলেন
তোমরা কি আমার সঙ্গে তামাশা করছো আমি দেশকে সর্বনাশের পথে ঠেলে দিতে পারিনা
হুদা ঘাবড়ে যায়, এদিকে বাড়ির একজন কাজের লোক ক্রন্দনরত অবস্থায় বলে ওঠে –
কামাল ভাই আর নেই
হাবিলদার মোসলেহউদ্দিন ছাঁদ থেকে নিচে নামা অবস্থায় সিঁড়িতে মুজিবকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সাথে সাথে পেছন থেকে তাঁর স্বয়ংক্রিয় বন্দুক দিয়ে মুজিবের সমস্ত পিঠে গুলি করে ঝাঁঝরা করে ফেলে, মুজিব লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। এদিকে সৈন্যরা মুজিবের বাড়ি থেকে হাতের সামনে যা যা পাচ্ছিলো তাই তাই লুটে নিচ্ছিলো, মুজিবের স্ত্রী মিনতি করে তাদের উদ্দেশ্যে বলেন
তোমরা সবকিছু নিয়ে যাও কিন্তু আমাদের জীবন নিওনা
কিন্তু নিচে বন্দুকের গুলির বিকট শব্দে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে উপলব্ধি করেন, মুজিব আর নেই। তিনি ব্যাকুল হয়ে কেঁদে উঠে বলেন,
তোমরা ওকে শেষ করে দিয়েছ, আমাকেও আর রেখো না
বেগম মুজিবকেও গুলি করে মেরে ফেলা হলো। শেখ জামাল, তার স্ত্রী রোজী এবং কামালের স্ত্রী সুলতানা তখন ছিলো ড্রেসিং রুমে , বন্দুকধারীরা সেই কামরায় ঢুকে স্টেনগান দিয়ে তিনজনকে চিরতরে শেষ করে দেয়। তারা নাসের কে একটি বাথরুমে আবিষ্কার করে, তাকে ওখানেই হত্যা করা হয়। রাসেল একটা ঘরের এক কোনায় ভীত হয়ে বসেছিল, তার চোখে পানি। সে কেঁদে বলে,
আমাকে আমার মায়ের কাছে নিয়ে চলো
একজন উন্মাদ বন্ধুকধারী বলে ওঠে –
চল তোকে তোর মায়ের কাছে পৌঁছে দিবো
একজন পুলিশ কর্মকর্তা রাসেলকে হত্যা না করার অনুরোধ জানালে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। এদিকে রাসেলের এক হাতে গুলি করা হয়, রাসেলের প্রচন্ড ব্যথায় ককিয়ে উঠে তার জীবন ভিক্ষার আবেদন করে, একটি বুলেটের মাধ্যমে তার জীবন ভিক্ষার আবেদন নাকচ করে দেওয়া হয়। ফারুক ও রশীদ একটু দেরী করে মুজিবের বাড়িতে ঢোকে। তারা পুরো বাড়ি পরিদর্শন করে দেখে, সবকিছু পরিকল্পনা মাফিক হয়েছে কিনা। ফারুক এই সংবাদ পৌঁছে দেওয়ার জন্য ঐ মুহূর্তে কাউকে ফোন করে।
শেখ মণি এদিন অনেককে ফোন করেন কিন্তু কোথাও থেকে সাহায্য পেলেন না। এরপর ইতোমধ্যে জোরপূর্বক বাড়ির ভেতরে প্রবেশকারী আর্মির লোকজনদের সঙ্গে কথা বলার জন্য বের হয়ে আসেন তিনি, তাঁর স্ত্রী আরজুও বসার ঘরে ঢুকবেন, এমতাবস্থায় একজন বন্দুকধারী স্বামী স্ত্রী উভয়ের উদ্দেশ্যে গুলি ছোড়ে। দুজনেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মণি সাথে সাথে মারা যান কিন্তু স্ত্রী তখনও জীবিত, তিনি অনুচ্চস্বরে পানির আবেদন জানান ।মনির ৩ বছরের ছেলে তাপস জিজ্ঞাসা করে –
মা, তোমরা মাটিতে পরে আছো কেন ? কথা বলছো না কেন ?
আরজু কাউকে উদ্দেশ্য করে বলেন –
আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চলেন, আমার দুটো ছোট ছোট বাচ্চা রয়েছে
৩য় বারের মত মা হতে চলা আরজুর এটাই ছিলো শেষ বাক্য ।
সেরনিয়াবত যখন বুঝতে পারলেন অস্ত্রধারী সৈন্যরা তাঁর বাড়ি চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে, তখন তিনি মুজিবকে ফোন করেছিলেন কিন্তু মুজিব নিজেই তো বিপদের মুখোমুখি। এরপর সেরনিয়াবত মণির বাসায় ফোন করেন, কিন্তু অপরপ্রান্ত থেকে কেউ ধরে না। সেরনিয়াবত বসার কামরায় প্রবেশ করেন, তাঁর পিছুপিছু তাঁর স্ত্রী পুত্র কন্যা ভাগে শহীদ, কজন অতিথি এবং বাড়ির কাজের লোকজনও প্রবেশ করে। তাঁর ছেলে আবদুল হাসনাত জানালা দিয়ে বের হতে চেয়েছিলেন কিন্তু না পারায় একটি রিভলভার নিয়ে ড্রেসিংরুমে লুকিয়ে ছিলেন। অন্তত মরার আগে তিনি একজনকে মেরেই তবে মরবেন।
মেজর শাহরিয়ার ও হুদার নেতৃত্বে একদল অস্ত্রধারী সেরনিয়াবতের ঘরে প্রবেশ করে। সেরনিয়াবত মেজর শাহরিয়ারকে তাঁর কমান্ডিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেওয়ার জন্য বলেন কিন্তু শাহরিয়ার জানায়, তাদের কোন কমান্ডিং অফিসার নেই এবং সেরনিয়াবতকে আপনি কে – বলে পাল্টা প্রশ্ন করে। অর্থাৎ একজন ব্যক্তিকে না জেনে না চিনেই সে অপারেশনে তাকে হত্যা করতে যায় । সেরনিয়াবত নিজের পরিচয় দিতেই শাহরিয়ার মুচকি হেসে সেরনিয়াবতের সারা শরীর বুলেট দিয়ে ঝাঁঝরা করে দেয়। তাঁর কন্যা হামিদা তাঁকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলে হামিদাকে পায়ে গুলি করা হয়। হাসনাতের ৩ বছরের ছেলে বাবু ভয়ে কেঁদে উঠলে শহীদ তাকে কোলে নেন, হাসনাত ভেবে তাকে ও বাবু – দুজনকেই গুলি করে মেরে ফেলা হয়। বাড়ির ভেতরে এলোপাথাড়ি গুলি বর্ষণ করা হয়, সেরনিয়াবতের চৌদ্দ বছরের কন্যা বেবী, নয় বছরের ছেলে আরিফ এবং তিনজন অতিথিকে গুলি করে সেদিন মেরে ফেলা হয়। সেদিন যারা প্রাণে বেঁচে যান কিন্তু আহত হন, তারা হলেন সেরনিয়াবতের স্ত্রী আমিনা, কন্যা হামিদা এবং ছেলে খোকন। হুদার ভাই নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, হাসনাতকে খুঁজতে থাকে।
গুলির শব্দে ধানমন্ডি এলাকায় বসবাসরত একজন ভারতীয় কূটনীতিক তাঁর বারান্দায় এসে দাঁড়ান, সেখানে এককালের মুক্তিযোদ্ধা এবং তৎসময়ে ব্যবসায়ী একজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন, যেন কোন আনন্দ সংবাদ আসতে যাচ্ছে । সেই নেমকহারাম ব্যবসায়ী আনুমানিক ৬.০১ মিনিটে কূটনীতিককে জানান, “কাজ শেষ, এখন রেডিও শুনুন”, কাজ যে শেষ তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী অপারেশন লিকুইডেশনের সমাপ্তি সূচক একটি রকেট নিক্ষেপের মাধ্যমে, মোহাম্মদপুরের বস্তিতে এটি বিস্ফোরিত হয়ে ৮ জনের প্রাণ কেড়ে নেয়।
ঢাকা রেডিও’র প্রচারে মেজর ডালিম বলে –
Under the leadership of Khandaker Moshtaq, the armed forces have taken over
প্রচারে আরো বলা হয়, সেনাবাহিনী মুজিব সরকারকে উৎখাত করে দেশের স্বার্থে তাকে বন্দি করেছে । একটু পরে আরেকটি ঘোষণা দিয়ে বলা হয় –
The ousted President Sheikh Mujibur Rahman has been killed at his residence during the army take-over
সেনাবাহিনী ক্ষমতা অধিগ্রহণের সময় উচ্ছেদকৃত রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছেন । আরো বলা হয়, শেখ মুজিবের বাড়ি থেকে নাকি পাল্টা আক্রমণ করা হয়েছিলো !
আমেরিকান অ্যাম্বাসেডর ইগুয়েন বোস্টারকে সেদিন সকালে অফিসে এবং বাসায় কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন থেকে যায়, এত সকালে বোস্টার কোথায় গিয়েছিলেন ?
মুজিব হত্যার আরেক ষড়যন্ত্রকারী মাহবুবুল আলম চাষী ১৩ই আগস্ট কুমিল্লা থেকে উধাও হয়ে যান। কুমিল্লা একাডেমীতে তার সহকর্মীরা ভেবে পাচ্ছিলেন না, চাষী কাউকে কিছু না বলে কোথায় গেলেন। সেই চাষীকে ১৫ই আগস্ট সকালে মোশতাক ও তাহেরউদ্দিন ঠাকুরের সাথে ঢাকার রেডিও স্টেশনে যায়। এই তিন ষড়যন্ত্রকারী যারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ নস্যাৎ করে যুদ্ধবিরতির পাঁয়তারা করছিলো, তারা এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে তাদের সেই মহাপরাজয়ের প্রতিশোধ তুললো।
১৯৭৫ সালে নিহত মুজিব পরিবারের সদস্যগণ
মুজিবের স্ত্রী, তিন ছেলে এবং দুই পুত্রবধূকে রক্তাক্ত কাপড়েই বনানী গোরস্থানে দাফন করা হয়, কিন্তু নিজেদের ইসলামের সিপাহী বলে দাবী করা সেই তথাকথিত মুসলিম ঘাতক চক্র সেখানে কোন জানাজা কিংবা ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে দেয়নি। উপরন্তু কার কবর কোনটা, সেটাও চিহ্নিত করে রাখেনি। মুজিবের জন্যও বনানীতে কবর খোঁড়া হয়েছিলো, তবে মুজিবের লাশ এখানে দাফন করলে তার পরিণতি ভয়াবহ হবে এমন আশংকায় তারা ১৬ই আগস্ট সকালে একজন মেজর, একজন লেফটেন্যান্ট ও কিছু সৈন্যকে মুজিবের লাশসহ হেলিকপ্টারযোগে টুঙ্গিপাড়া পাঠায়। সেই দল গ্রামের মসজিদের ইমাম সাহেবকে ডেকে জিজ্ঞাসা করে গ্রামের লোকজন কি শেখ মুজিবের লাশ দাফন করবে ? উত্তরে জানানো হয়, যদি মরদেহ হস্তান্তর করা হয় তবে তারা দাফন করবে। গ্রামবাসীদের বলা হয়, তাদেরকে মুজিবের কবর ছাড়াও আরো ১০ -১২টি কবর খুঁড়তে হবে। দুপুর ২.৩০ নাগাদ সেনাবাহিনীর কয়েকজন সেই লাশ নিয়ে উপস্থিত হয়, সেখানে গোপালগঞ্জ মহকুমার ম্যাজিস্ট্রেট একটি পুলিশবাহিনী নিয়ে উপস্থিত ছিলেন। যদিও ইসলাম সম্মত নয়, তবুও মেজর চাচ্ছিলো কফিনসহ লাশ কবর দিতে। গ্রামবাসীরা দাবী করেন –
আমাদের লাশ দেখতে দিতে হবে
মেজর সংকুচিত হয়ে বলেন –
লাশ না দেখে কি কবর দেওয়া যায়না ?
মৌলভী শেখ আব্দুল হালিম বলেন –
যায়, তবে আপনাদের তাঁকে শহীদ বলে ঘোষণা দিতে হবে।
সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো, তখন মৌলভী বলেন –
আপনারা কি তার দাফন কাফন ইসলামিক আইন অনুযায়ী করতে চান না ?
শুনে চারিদিক নীরব নিস্তব্ধ। উত্তেজনাকর মুহূর্ত । অফিসারেরা দোটানায়। যদিও ওপর থেকে কঠোর নির্দেশ – গ্রামবাসীদের মুজিবের মরদেহ দেখানো যাবেনা। কিন্তু তারা উপলব্ধি করলো যে, যদি একজন মুসলমানকে মুসলমান গ্রামবাসীদের সামনে ইসলামী আইন অনুযায়ী কবর দেওয়া না হয়, তাহলে সেখানে বিদ্রোহের সৃষ্টি হতে পারে। এই কথা চিন্তা করে মেজর বললো –
হ্যাঁ, ইসলামিক আইন অনুযায়ীই হবে তবে তাদের উপস্থিতিতেই কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।
কফিন খোলা হলো। মুজিবের সারা দেহ বুলেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত এবং বরফ দেওয়া সারা কফিনটি লাল রক্তে মাখামাখি । গ্রামবাসীরা কফিনের আশেপাশে ভীড় জমাতে লাগলো এবং হতভম্ব ও নির্বাক হয়ে গেল। এদিকে পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো থেকে শত শত মানুষ ছুটে আসতে শুরু করলো, তাদেরকে লাশের সামনে পৌঁছুতে বাধা দেওয়া হলো, কিন্তু যে কোন মুহূর্তে তারা সে বাধা ভেঙে এগিয়ে আসতে পারে, এজন্য প্রথমে এক লেফটেন্যান্ট চিৎকার করে তাদেরকে ফিরে যেতে বললো এবং ইমামকে বললো তাড়াতাড়ি করতে। আর মেজর কুকুরের মত ঘেউঘেউ করে চেঁচিয়ে উঠলো –
আপনাদের আর পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হলো।
মুজিবের লাশ তার গ্রামের বাড়ীর বারান্দাতে রাখা হয়। মুজিবের দেহে ৩৫টি বুলেট বিদ্ধ হয়েছিলো, ১টি বুলেট একটি অটোমেটিক রিভলভারের মাধ্যমে তার পেছন দিয়ে শরীরে ঢোকে, অর্থাৎ মোসলেহউদ্দিন ছাড়াও আরেকজন তাঁকে গুলি করেছিলো। মুজিবের পরনের কুর্তার পকেটে ধূমপানের পাইপ ও ভাঙা চশমাটি ছিলো। মুজিবের গ্রামের বাড়িতে ঐ মুহূর্তে কেউ ছিলেন না, আশেপাশের সকল দোকান পাটও বন্ধ ।একজন গ্রামবাসী একটি সাবান নিয়ে আসে। লাশের শেষ গোসলের জন্য গরম পানির ব্যবস্থা করা হলোনা। লাশ থেকে রক্ত পরিস্কার না করা হতেই উপস্থিত মেজর আবার ঘোঁতঘোঁত করে উঠলো –
তাড়াতাড়ি করুন, আপনাদের আর কত সময় লাগবে।
মুজিবের মায়ের নামে প্রতিষ্ঠিত সায়েরা খাতুন হাসপাতাল থেকে কয়েকজন গ্রামবাসী ৪টি শাড়ি নিয়ে আসেন। তারা শাড়ির লাল পাড় ছিড়ে ফেলেন কিন্তু মেজর কাফন সেলাই করতে দিলো না। জানাজা হবে কিনা এমন প্রশ্নে মেজর সম্মতি জানালো এবং বললো তারা জানাজায় অংশগ্রহণ করবে কিনা।পুলিশ উত্তরে বললো- তারা যদি পাক পবিত্র অবস্থায় থাকে তবেই তারা জানাজায় অংশ নিতে পারবে। তারা জানাজায় অংশ নিতে ব্যর্থ হলো। মুজিবকে তাঁর পিতার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হলো ।
সততা ও নিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা সহজ সরল সাদাসিদে বঙ্গবন্ধু
নেতার নেতা শেখের ব্যাটা শেখ মুজিব
তিনি (মুজিব) রাজনীতির কবি, কৌশলী নন – নিউজউইক
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চিরকালই অসম্ভব সৎ এবং নিষ্ঠাবান ছিলেন কিন্তু কূটনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন না। ক্যারিশমাটিক এই নেতা তাঁর আবেগময় জ্বালাময়ী বক্তব্যের মাধ্যমে সহজেই জনমনে আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারতেন, সেজন্যই নেতা হিসেবে তিনি জনমানসে হিমালয়সম উচ্চতায় আসীন ছিলেন, কিন্তু একজন রাষ্ট্রনায়ক হতে হলে যে কূটচাল ও কূট বুদ্ধিও রাখতে হয় এবং সময়ে সময়ে সেই কূটনীতিগুলোর প্রয়োগ ঘটাতে হয়, সেটি তিনি বুঝতেন না। সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তিদের মধ্যে একপ্রকার সহজ সরল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য থাকে, যেগুলোকে বিপক্ষ অসৎ ও কূটচাল সম্পন্ন ধূর্ত ব্যক্তিদের কাছে বোকামি বলে প্রতীয়মান হয়। বঙ্গবন্ধু যে সৎ সহজসরল এবং বোকা ছিলেন, সেটি তাঁর বিপক্ষ কুখ্যাত কূটনীতিবিদ মার্কিন ডাকসাইটে পররাষ্ট্র সচিব হেনরী কিসিঞ্জারও স্বীকার করে গেছেন –
He was one of the world’s prize fools
কিসিঞ্জার: তিনি (মুজিব) ছিলেন বিশ্বসেরা বোকাদের অন্যতম।
বঙ্গবন্ধুর এই সহজসরলতাকেই কাজে লাগিয়ে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি পাকিস্তান ও ইসলামপন্থী কয়েকজন বিপথগামী সামরিক অফিসারেরা ১৫ই আগস্ট তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের ধারাকেই আমূল বদলে দেয়। ইচ্ছে না থাকলেও অবস্থার প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালে বাধ্য হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা কতিপয় সামরিক অফিসারেরাও এই হত্যাকাণ্ডে সক্রিয় ও পেছন থেকে সংশ্লিষ্ট থাকে ।
সহজ সরল ছিলেন বলেই কে শত্রু আর কে মিত্র সেটি বঙ্গবন্ধু চিনতে পারেননি, সরল বিশ্বাসে পুরো জাতিকেই তাঁর সন্তান বলে মনে করেছেন এবং সন্তান যে একদিন পিতাকে হত্যা করবে – এমন ভাবনা বা আশংকা তাঁর মধ্যে কোনদিনও আসেনি। মুজিব-এর হত্যাকান্ডের কথা জানতে পেরে তাজউদ্দিন স্বগতোক্তি করেছিলেন,
বঙ্গবন্ধু জানতে-ও পারলেন না- কে তার শত্রু আর কে তার বন্ধু ছিল
হেনরী কিসিঞ্জারের সঙ্গে আলাপকালে মিঃ এথারটন বলেছেন –
He brushed it off, scoffed at it, said nobody would do a thing like that to him.
এথারটন: তিনি (মুজিব) তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেন। বলেন, তাঁর সঙ্গে এমন কিছু কেউ করতেই পারে না।
এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু যে কত্টা সোজা সরল মানুষ ছিলেন, সেটিই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বঙ্গবন্ধু মিন্টো রোডে প্রেসিডেন্ট হাউজে বিকেল ৩ টা পর্যন্ত অফিস করতেন,তারপর চলে আসতেন শেরে বাংলা নগরের সচিবালয়ে যেখানে তিনি রাত ৯/১০টা পর্যন্ত অফিস করতেন। ওখানেই তিনি দুপুরে কিছু সময় বিশ্রাম নিতেন,সময় সুযোগ পেলে বিকেলে লেকে মাছদের খাবার দিতেন,লনে একটু হাঁটাহাটি করতেন। বঙ্গভবন বঙ্গবন্ধুর সরকারি বাসভবন হলেও তিনি রাতে ওখানে থাকতেন না, থাকতেন ধানমন্ডি ৩২ নং রোডের নিজ বাড়িতে। একজন রাষ্ট্রনায়ক সরকারী সুযোগসুবিধা নিচ্ছেন না এবং নিজের নিরাপত্তার জন্যও প্রয়োজনীয় সিকিউরিটি ফোর্স রাখছেন না – এখান থেকেই সুস্পষ্ট হয়, বঙ্গবন্ধু কোনদিনও দুর্নীতিবাজ ছিলেন না। একজন বাঙালি ঔপন্যাসিক মুজিব সম্পর্কে বলেন –
অন্যান্য মধ্যবিত্ত বাঙ্গালির মত মুজিবও তার বাড়ি ভালবাসতেন। তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখনও তাঁর বসবাসের ধরন পরিবর্তিত হয়নি। তাঁর বাড়িতে কোন গালিচা বা নতুন আসবাবপত্র ছিলোনা। তিনি মাছ, মুড়ি, দই ও গুড় পছন্দ করতেন। তিনি লুঙ্গী ও গেঞ্জি পরে বাসায় বিশ্রাম নিতেন। তিনি একজন মধ্যবিত্ত বাঙালিই থেকে যান
১৯৭১-১৯৭৫ পর্যন্ত বাংলাদেশে চলে ছদ্মবেশী বিপক্ষ শক্তির তান্ডব ও গোয়েবলসীয় অপপ্রচার
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে দেশে হাজার সমস্যার মোকাবেলা করতে হয়। এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো:
১) যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের শুন্য নয়, বরং ঋণাত্মক অবস্থান থেকে যাত্রা শুরু করা,
২) আওয়ামী লীগ এবং আজকের বিএনপিপন্থী জামাত পন্থী (সে সময়ের আওয়ামী লীগার ও আর্মি সদস্যরা) ও বামপন্থীদের মধ্যে অন্তর্কোন্দল অর্থাৎ আওয়ামী লীগের ভেতরেই লুকিয়ে থাকা
ক) বাংলাদেশবিরোধী ও বঙ্গবন্ধুবিরোধী স্বার্থান্বেষী চক্রের চরম দুর্নীতি ও লুটপাট,
খ) বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে ভণ্ড বামপন্থীদের লুটতরাজ সন্ত্রাস এবং
গ)) শেখ মুজিবেরই কতিপয় আত্মীয়ের শেখ মুজিবের নাম ভাঙিয়ে বিশৃঙ্খলা ও অরাজকতা কায়েম
ঘ) বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর মধ্যে সুপ্ত গোঁড়া ইসলাম ও পাকিস্তান প্রীতি
ঙ) বঙ্গবন্ধুবিরোধী বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের নজিরবিহীন চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র
ছদ্ম আওয়ামী লীগার তথা বঙ্গবন্ধুবিরোধী স্বার্থান্বেষী চক্রের চরম দুর্নীতি লুটপাট ও সুবিধা গ্রহণ
আওয়ামী লীগের মধ্যে লুকিয়ে থাকা স্বার্থান্বেষী চক্রের অনেকেই আজকে বিএনপি জামাতে সহ বিভিন্ন দলের সমর্থক, অথচ এদের অপকর্মের দায়ভার আওয়ামী লীগের ঘাড়েই চাপানো হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপানো হয়েছে, দুর্নীতি করলো এরা অথচ বদনাম হলো আওয়ামী লীগের, শেখ মুজিবের ! খন্দকার মোশতাক আহমেদ, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষী, শাহ মোয়াজ্জেমসহ অনেকেই আছেন এই ছদ্ম আওয়ামী লীগারের তালিকায় যারা দেশের জন্য কিছুই করেননি। মওলানা ভাসানী ৭৫’এর পরে নিজের নগ্ন স্বার্থান্বেষী চরিত্রটি উন্মোচিত করে বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে দায়ী সরকারকে সমর্থন জানিয়েছেন। জেনারেল ওসমানী,কর্নেল তাহের, আসম আব্দুর রব, সিরাজুল আলম খানসহ অনেকেই আছেন যারা আওয়ামী ভেঙে দিতে চেয়েছেন বা ত্যাগ করেছে বা শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডে চুপ থেকে মৌন সমর্থন প্রদান করেছেন । অধ্যাপক আলী আহসান, মওদুদ আহমেদসহ অনেকেই রয়েছেন এই লিস্টে যারা পরবর্তীতে বিএনপিতে যোগদান করেছেন। আওয়ামী লীগ নেতা কফিলউদ্দিন সাহেবের পুত্র ডাঃ বদরুদ্দোজা জিয়াউর রহমানের সুযোগসুবিধা দান করার লোভে নিজের ঈমান বেঁচে দিয়ে বিএনপিতে যোগদান করেছেন। এদের অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হয়েছেন। এই কি ন্যায়বিচার, এরা করলো দুর্নীতি লুটপাট, এরাই নিলো সুবিধা অথচ বদনাম হলো আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুর ? তবে এদের কারণে দেশের ক্ষতি হলেও মুজিব সরকারের মুজিবপন্থী দেশপ্রেমিক নেতাদের জানপ্রাণ প্রচেষ্টা অব্যাহত ছিলো । তারা চেষ্টা করেছিলো, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে শূন্য নয় বরং ঋণাত্মক অবস্থান থেকে সংহত অবস্থানে টেনে তোলার । জাতিসংঘের সাবেক আন্ডার-সেক্রেটারি জেনারেল ড. আমব্রিখট মুজিব সরকারের সাফল্যের একটি উল্লেখযোগ্য বিবরণ দেন। তিনি লিখেছেন,
গত ১২ মাস ধরে দেশের অর্থনীতির বিরাট উন্নতি ঘটেছিল। ভালো খাদ্য পরিস্থিতি, বৃহত্তর খাদ্য মজুদ, ব্যাপক রপ্তানি ও ঘাটতিবিহীন বাজেটও ছিল। ধর্মঘট ছিল না। ছিল ভালো জনকর্মসুচি, ভালো “কাজের বিনিময়ে খাদ্য” প্রকল্প, কম বেকারত্ব, অধিকতর দক্ষ জনপ্রশাসন (যদিও এখনো দুর্দশা কাটেনি) প্রভৃতি। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক নেতৃত্বের উত্তম অংশটিকে কেন নির্মুল করা হলো, তা বিচার করা দুরূহ। আমাদের তা দেখা ও বোঝার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
অভিজ্ঞতাহীন রক্তগরম তরুণদের নষ্ট করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে ভণ্ড বামপন্থীদের লুটতরাজ সন্ত্রাস
মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু চীনপন্থীরা নিজের মাতৃভূমির চেয়ে চীনের বৈদেশিক নীতির স্বার্থ বেশি দেখে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেছেন। সিরাজ শিকদার তাদের ই একজন। বরিশালের পেয়ারা বাগানে তিনি মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সাথে লড়াই চালিয়েছেন। অনেকে হয়তো বলবেন, কোন ‘মহান’ আদর্শের জন্য তিনি এ কাজ করেছেন। তাহলে রাজাকারদের আর কি দোষ? তারাও তো ‘মহান’ ধর্মরাষ্ট্র অক্ষুণ্ণ রাখতে এই কাজ করেছেন। হত্যার রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত, নিজের দলের মাঝেই গণহত্যাকারী সিরাজ শিকদারকে মানবতাবাদের প্রচারক ভাবাও দুষ্কর। সামান্য সন্দেহ হলেও নিজের ঘনিষ্ঠ সহচরের রক্তে হাত রাঙ্গানো সিরাজ শিকদারকে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা করার মত আমি কোন কারণ খূঁজে পাই না। ভারতের মাওবাদী নকশালপন্থী চারু মজুমদারের অন্ধ অনুসরণে সিরাজ শিকদার সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পথ বেছে নিয়েছিলেন স্বাধীনতার পরপর। নকশালবাড়ি বলে একটা জায়গা থেকে চারু মজুমদার ও তার দলের সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল বলে পরে নকশালপন্থী শব্দটা চরমপন্থী মাওবাদীদের বোঝাতে ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। থানা দখল, পুলিশের অস্ত্র লুট, ব্যাংক লুট, জোতদার (গ্রামের ভূস্বামী) ও আওয়ামী লীগের নেতা-সমর্থকদের হত্যা ছিল তার রাজনৈতিক কৌশল। তার রাজনীতি সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করলেও সাধারণ মানুষের মধ্যে এর প্রতিক্রিয়া ছিল সামান্যই। ঢাকা ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী ওই রাজনীতিতে আকৃষ্ট হলেও পশ্চিমবঙ্গে নকশালবাড়ি আন্দোলন যতোটা তরুণ-যুবকদের টেনেছিল বাংলাদেশে সেটা হয়নি। পুলিশ বলেছিল, গ্রেপ্তার হওয়া সিরাজ শিকদার তাদের গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যেতে চাইলে গুলিতে তিনি নিহত হন।পুলিশের এই কথা যদি মিথ্যেও হয়ে থাকে, তারপরও এটা তো সত্য যে, সিরাজ শিকদার ছিলেন ঠাণ্ডা মাথায় অজস্র লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের খলনায়ক । সুস্পষ্টভাবে, এমন সন্ত্রাসী খুনী এবং চরমপন্থী ব্যক্তি মারা গেলেই দেশ ও জাতির মঙ্গল। যদি পুলিশ তাঁকে ক্রসফায়ার করে থাকে, তো সেটি নিশ্চিতভাবেই সঠিক ছিলো।
শেখ মুজিব নিজেই একজন গণতন্ত্রী এবং সমাজতন্ত্রী ছিলেন এবং সেজন্যই গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রকে একসূত্রে বাঁধতে চেয়েছিলেন, এমন বৈপ্লবিক ধ্যানধারণা আমাদের দেশের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ৫ টাকার লিফলেট বিক্রি করা এবং প্রধানমন্ত্রীকে ফাউ ফাউ স্মারকলিপি প্রদান করা বামপন্থী চৈনিকদের পছন্দ হয়নি, তাদের আদর্শ চীন যেমন ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলোনা তেমনি তারাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয় ছিলোনা। শেখ মুজিব দেশ গড়ার কাজে মুক্তিযোদ্ধাদের অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করা এবং অনেকটাই নিষ্ক্রিয় থাকা বামচৈনিকেরা দেশের সরকারের মধ্যে কোন যুক্তিতে স্থান পাবে ? ফলে যা হবার তাই হলো, সরকারে এবং দেশের বিভিন্ন পদে চৈনিক বামপন্থীরা সুযোগ না পেয়ে উগ্র চরমপন্থী মাওবাদী কায়দায় দেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ও মাও সে তুং স্টাইলের বুলি আওড়ে দেশের রক্তগরম এবং অভিজ্ঞতাহীন তরুণসমাজের ব্রেন ওয়াশ করতে লাগলো, এদেরকে সশস্ত্র সংগ্রামের নামে হত্যাযজ্ঞ,লুটপাট, অরাজকতা,সন্ত্রাস, চুরিডাকাতি,রাহাজানি ইত্যাদি অসামাজিক বিশৃঙ্খল ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লেলিয়ে দিলো। এদের অপরাধটা কেউ দেখলো না, সবাই ভাবলো আওয়ামী লীগ এই অপরাধ দমনে ব্যর্থ। এদের নিয়ন্ত্রণে সরকার সক্রিয় হতে শুরু করলে এরাই দেশে অপপ্রচার চালালো, আওয়ামী লীগ দেশে দমননীতি চালাচ্ছে ! দেশের শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার্থে সক্রিয় হলেও বিপদ ! তাহলে কোনদিকে যেত আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু কিংবা পৃথিবীর কোন মহান রাষ্ট্রনায়কও এই বন্ধুর পরিস্থিতিতে এর চেয়ে বেশি কিছু করতে পারতেন না।
বঙ্গবন্ধুর কতিপয় আত্মীয় এবং তথাকথিত চাটুকারদের দাপট এবং হত্যাকাণ্ডে মেজর ডালিমের সংশ্লিষ্টতা
বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে একেবারেই দুর্নীতিগ্রস্ত ছিলেন না, কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্থপতি বলে তারই কতিপয় আত্মীয় ও তথাকথিত বন্ধু শ্রেণীর ব্যক্তিগণ সেটার অবৈধ সুযোগ গ্রহণ করা শুরু করে, বঙ্গবন্ধু তাদের কাছ থেকে সততা ও নিষ্ঠা আশা করেছিলেন কিন্তু সেই আশায় গুড়ে বালি দিয়ে তারা, ঔদ্ধত্য এবং অরাজকতা সৃষ্টির মাধ্যমে নির্দোষ বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তি জনমানসে ধীরে ধীরে কলঙ্কিত করে তোলেন। দোষ তাদের, কিন্তু জনগণ সেটি অনুধাবন না করেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি খুব্ধ হয়। এই সকল আত্মীয় ও বন্ধুদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শেখ মণি ও গাজী গোলাম মোস্তফা। মেজর ডালিম বঙ্গবন্ধুর এবং বেগম মুজিবের প্রতি অনুগত ছিলো, বঙ্গবন্ধু ও ডালিম একসঙ্গে মুড়িও খেত। সমস্যার সূত্রপাত হয় যখন ডালিমের বোনের বিয়েতে ডালিমের সুন্দরী স্ত্রী তাসনিমকে গাজী গোলাম মোস্তফার এক ছেলে উত্যক্ত করার চেষ্টা করে। ডালিম তাকে চড় মারে । তখন গাজী ডালিমকে মুজিবের বাড়িতে নিয়ে যায় এবং সবসময় বিরোধ নিষ্পত্তিকারী মুজিব – গাজী ও ডালিমের হাত মিলিয়ে দেন ও বিরোধ দূর করে খুশি হন এবং সবাইকে মিষ্টি খেতে বলেন। কিন্তু ব্যাপারটি এখানেই শেষ হয়না। প্রতিশোধপরায়ণ ডালিম কতিপয় সেনা কর্মকর্তাকে নিয়ে গাজীর নয়াপল্টনের বাড়িতে আক্রমণ করে এবং সবকিছু তছনছ করে ফেলে, উপরন্তু হুমকি দেয় ডালিমের কিছু হলে শহরে রক্তগঙ্গা বয়ে যাবে। এ নিয়ে গাজীর অভিযোগের ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর জেনারেল হেডকোয়ার্টার বিষয়টি তদন্ত করে এবং যেসব কর্মকর্তা জড়িত ছিলো। তাদের চাকুরী থেকে অব্যাহতি দেওয়ার নির্দেশ দেয়, কেননা শৃঙ্খলাই সেনাবাহিনীর আইন। মুজিবের কয়েকজন বন্ধু এব্যাপারে এই চাকুরী চ্যুতি থামানোর জন্য মুজিবকে অনুরোধ করলেও ডালিম তাঁর বিরোধ মীমাংসাকে অবজ্ঞা করে অমন কাজ করেছে দেখে বলেন –
এটি সেনাবাহিনীর সদর দফতরের সিদ্ধান্ত
এতে ডালিম ক্রুদ্ধ হয় এবং বিভিন্ন জায়গায় এই নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা করে বেড়াতো আবার ঠিকই বঙ্গবন্ধুর বাসায় আসতো । এটির কারণে একদিন শেখ রেহানা তাকে স্পষ্টভাষায় এই নিয়ে ডালিমকে বলেন – “ আপনি যখন বাবা সম্পর্কে এসব কথা বলেন, তখন কেন আমাদের বাসায় আসেন” এ নিয়ে ডালিমের শাশুড়ি হেনা, যিনি শেখ হাসিনার বান্ধবী এবং বয়সে বেশ বড় হওয়ার কারণে বেগম মুজিবেরও বান্ধবী, তিনি তার জামাতাকে তাদের সামনে ভর্ৎসনা করেন যে “ তোমার এরকম দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা বলা উচিত নয়” এতে চরম প্রতিহিংসাপরায়ণ ডালিম আরো ক্ষেপে যায় এবং ক্ষেপলে সে বিবেকবর্জিত পশুর মত আচরণ করতো। মুজিব হত্যা পরিকল্পনায় এসব কারণেই ডালিম সংশ্লিষ্ট হয়েছিলো তবে তাঁর স্ত্রী তাসনিম মুজিব হত্যার পরে পাগলের মত হয়ে যায়, ডালিমের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা জন্মায় তাঁর, মেজর দেখলেই সে থুতু ফেলতো। মুজিব হত্যার পরে এরকম পাগলের মত হয়ে যাওয়া মানুষ আমি (লেখক) অজস্র দেখেছি, কালকে ফেসবুকেই দেখলাম একজনের ম্যাসেজে) কিন্তু সেসময় আর্মি শাসনের অস্থিতিশীলতায় ও মুজিব হত্যার চরম নৃশংসতায় মানুষ নির্বাক হতবাক হয়ে গিয়েছিলো, নীরবে তারা চোখের জল ফেলেছে, কিন্তু প্রকাশ করতে পারেনি তাদের দুঃখ বেদনা যন্ত্রণা আহাজারি। এই বিষয়টিকে রাজাকারপন্থী বিএনপি জামাতেরা অশ্লীলভাবে ব্যাখ্যা করে যে, বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে জনগণ কষ্ট পায়নি । প্রকৃতপক্ষে তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবিত মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ যেখানে পাকিস্তানপন্থী প্রো ইসলামিক ব্লকের আধিপত্যের কারণে ন্যুব্জ ও দিশেহারা, সেখানে সাধারণ জনগণ তো আরো বেশি দিশেহারা এবং অসহায় বোধ করবে এবং সেসময় কিছু করতে গেলে দেখা যেত, আর্মিরা বিদ্রোহীদের চরমভাবে দমন করছে, দেশে পুনরায় হয়তো গৃহযুদ্ধ লেগে যেত। তাছাড়া আওয়ামী নেতাদেরও সেসময় খুনী চক্রের কারণে আত্মগোপন করতে হয়েছিলো, ফলে জাতি ছিলো একেবারেই কুলকিনারা ও দিকনির্দেশনাহীন। অস্ত্রের মুখে নিরস্ত্র জনগণ নীরব হয়ে গিয়েছিলো, তাছাড়া আরেকটি বিষয় ছিলো – মানুষ চরম আঘাত পেলে শোকে পাথর হয়ে যায়। বাঙালিদের অবস্থা ছিলো তেমনই, অধিক শোকে পাথর সদৃশ ।
বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থদের মধ্যে সুপ্ত ধর্মান্ধতা ও পাকিস্তান প্রীতি
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর উচ্চ পর্যায়ের সদস্যদের অনেকেই ছিলেন পাকিস্তান আর্মিতে চাকুরী করা ছোটখাটো ও মধ্যম শ্রেণীর অফিসারেরা । জাতিসত্ত্বায় বাঙালি হওয়ার কারণে এদের কাউকে কাউকে অনিচ্ছাকৃত তথা বাধ্য হয়েই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়। মুজিব সামরিক বাহিনীতে নিয়োগের ব্যাপারে কোন নিয়ন্ত্রণ করেননি, এই নিয়ন্ত্রণ করা জরুরী ছিলো, সমমনা অফিসারদের উচ্চপদে নিয়োগ দিলে এবং পাকিস্তানপন্থী সদস্যদের সামনে আসতে না দিলে স্বার্থান্বেষী সামরিক বাহিনীতে মুজিবের পক্ষে দাঁড়ানোর মত ব্যক্তি থাকতো, পাকিস্তানপন্থী ব্লক মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারতো না। মুজিব ভুল করে সেই বিষধর গোখরা সাপকে দুধ খাইয়েছেন এই ভেবে যে, পাকিস্তানপন্থীদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করলে তারা হয়তো ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হয়ে বাংলাদেশমনা হয়ে উঠবে, দেশের জন্য কাজ করবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। মুজিব দুর্নীতিবাজ ছিলেন না বলেই সামরিক বাহিনীতে পাকিস্তানপন্থী কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করেননি। কে এম শফিউল্লাহ সেনাপ্রধান ছিলেন বটে কিন্তু তার হাতে প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতা ছিলোনা। কেননা, উপসেনাপ্রধান জিয়াউর রহমান তার সকল কাজে হস্তক্ষেপ করতেন এবং শফিউল্লাহ কিছুটা দুর্বল মনোবৃত্তি সম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তাছাড়াও পাকিস্তানী মনোভাবাপন্ন জিয়াদের ব্লকও তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী ছিলো, ফলে শফিউল্লাহ’র বিরুদ্ধেই হয়তো ক্যু সংঘটিত হয়ে যেত। অনেকে কে এম শফিউল্লাহকে দোষারোপ করেন কেন তিনি ঐ মুহূর্তে ব্যবস্থা নিলেন না। এই কেন’র উত্তর আর্মিতে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত ব্লকের সদস্যাধিক্যের মাঝেই নিহিত। চাইলেই সবসময় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়না। কে এম শফিউল্লাহর আরেকটি দুর্বলতা ছিলো যে জিয়াউর রহমানের কাছে পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমির উচ্চতর প্রশিক্ষণ ছিলো, যেটি যোগ্যতার বিচারে জিয়াকেই ভবিষ্যতের সেনাপ্রধান বানানোর ক্ষেত্রে একটি বড় প্লাস পয়েন্ট হিসেবে বিবেচিত হতে পারত ।
বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ সামনাসামনি প্রতিক্রিয়া না দেখালেই ভেতরে ভেতরে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি ফুঁসছিলেন, যার কারণে সুযোগ পাওয়া মাত্রই ৩রা নভেম্বরের ক্যুয়ের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানকে বন্দী করেছিলেন, যদিও মূর্খ ও অর্বাচীন কর্নেল তাহেরের ক্ষমার অযোগ্য হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণে জিয়াউর রহমানকে বিভ্রান্ত সিপাহীরা মুক্ত করে নিয়ে আসে এবং জিয়ার নির্দেশেই বাংলাদেশের ইতিহাসের সে সময় জীবিতদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ এবং তার দুই সহকর্মী এটিএম হায়দার এবং নাজমুল হুদাকে নৃশংসভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়।
মেজর জিয়াউর রহমান পশ্চিম পাকিস্তান ছিলেন অনেক দিন, রিসালপুর মিলিটারি একাডেমিতে ইন্সট্রাকটর হিসেবে। চট্টগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষে অস্ত্র খালাসের সময় জুনিয়র অফিসারদের তোপের মুখে বাধ্য হয়েই তাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হয়। উল্লেখ্য, জিয়া কোনদিন সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করেননি অর্থাৎ তার মধ্যে গা বাঁচানো এবং সুযোগসন্ধানী স্বভাবটি চিরকালই ছিলো। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার অন্যতম খলনায়ক ফারুক রহমান আবুধাবীতে পাকিস্তানী এক আর্মড রেজিমেন্টের স্কোয়াড্রন কমান্ডার ছিলেন, ১২ ডিসেম্বর তিনি পক্ষ বদলে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন, আরেক স্বার্থান্বেষী সুযোগসন্ধানী আব্দুর রশীদ যোগ দেন তার এক মাস আগে। এর আগে পশ্চিম পাকিস্তানেই ছিলেন তিনি,যুদ্ধ যোগ দেন পালিয়ে নয়,ছুটি নিয়ে!উল্লেখ্য রিসালপুরেই জিয়াউর রহমানের সঙ্গে এদের দুজনের প্রথম পরিচয়। অর্থাৎ, বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিলো প্রকৃতপক্ষে সুপ্ত ও বিপদের সময় দলবদলকারী পাকিস্তানপন্থী ব্যক্তিবর্গের দখলে। মুজিব সামরিক বাহিনীর লোকজনদের পেছনে বিপুল অর্থ খরচ না করে সেই অর্থ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দারিদ্র নিপীড়িত কৃষক শ্রমিক জনগণের পেছনে ব্যয় করতে প্রয়াসী ছিলেন। এতে করে স্বার্থান্বেষী সামরিক বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের অনেকেই মুজিবের ওপর রুষ্ট হয় কেননা তাদের পেছনে অর্থ বরাদ্দ ও সুযোগ সুবিধা কমিয়ে দিলে তাদের সেই প্রাত্যহিক বিলাসব্যসনের জীবন যাপন করা আর সম্ভব হয়ে উঠবেনা। আর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পূর্বে চাকুরী করার ফলে অন্যান্য পাকিস্তানী অফিসারদের গোঁড়া ইসলামিক মনোভাব এদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। মুজিব একজন পাক্কা মুসলমান ছিলেন, কিন্তু গোঁড়া বা ধর্মান্ধ ছিলেন না, তিনি সকল ধর্মের মিলনে বিশ্বাসী ছিলেন এবং এই অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাংলাদেশের মূলনীতিতে সংযোজিত করেছিলেন। এটি সামরিক বাহিনীর গোঁড়া মুসলিমদের মধ্যে চরম মুজিব বিদ্বেষের সৃষ্টি করে।
যাদেরকে আমরা বলি মুক্তিযুদ্ধের গর্ব, তাদের অনেকেই স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার নীল নকশাটি করেছিল।মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারদেরকে পৃথকীকৃত করার কোন উপায় আছে কি ? কর্ণেল তাহের, জেনারেল ওসমানী,জিয়াউর রহমান, মেজর আব্দুর রশিদ ইত্যাদি ব্যক্তিরা যদি মুক্তিযুদ্ধ করে থাকে তো পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধু হত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা এবং পাকিস্তানী রাজাকারদের পুনর্বাসনে এদের সক্রিয় ভূমিকা কেন ? জেনারেল ওসমানী মনে মনে তীব্র হিন্দু বিদ্বেষী ছিলেন, এর পেছনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকুরী করার সময় পাকিস্তানী আর্মি অফিসারদের মধ্যেকার ভারত ও হিন্দু বিদ্বেষের বিষয়টি দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। তাঁকে এবং জিয়াউর রহমানের কাউকে সেনাপ্রধান না বানিয়ে শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান বানানোর কারণে জেনারেল ওসমানী বঙ্গবন্ধুর ওপর রুষ্ট হন এবং অশোক রায়নার বই থেকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আলাপ আলোচনায় তার সংশ্লিষ্টতা ছিলো বলে জানা যায়।
তবে জিয়াউর রহমানের কথা আলাদা,আন্তর্জাতিক মদদে সে ছিল শেখ হত্যার মাস্টারদের মাস্টার মাইন্ডার। অশোক রায়নার বই ‘ইনসাইড র দ্যা স্টোরি অব ইন্ডিয়াস্ সিক্রেট সার্ভিস’ থেকে জানা গেছে বেগম জিয়ার বাড়ির ট্রেস থেকে উদ্ধার করা হয় তিন ঘণ্টা মিটিংয়ের পরে মুজিবের বিরুদ্ধে ক্যু-এর একটি স্ক্রাপ পেপার। কাগজটি যত্নসহকারে গার্বেজ করা হলে একজন গুপ্তচর গৃহভৃত্যের মাধ্যমে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দিল্লীতে পাঠিয়ে দিলে বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে দেয়ার জন্য ‘র’এর পরিচালক মি. কাউ পান বিক্রেতার ছদ্মবেশে বাংলাদেশে আসেন। বঙ্গবন্ধু সেটাকে যথারীতি উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ওরা আমার সন্তানের মতো। এই চিরকুটে যাদের নাম ছিল, জিয়াউর রহমান, মেজর রশিদ, মেজর ফারুক, জেনারেল ওসমানী এবং মেজর শাহরিয়ার। বঙ্গবন্ধু হত্যা বিচারকালে, বেগম জিয়াকে সাক্ষী হিসেবে আমলে নেয়া কি খুবই অযৌক্তিক ? জিয়ার নাম তো লিস্টেই ছিল। মরনোত্তর বলে তাকে অব্যহতি দেয়ার বিরুদ্ধে উল্লেখ আছে রায়ের ১৩৬ পৃষ্ঠায়।
১৫ই আগষ্ট সফল হওয়ার পর রাজাকার শক্তির কেন পুনরুত্থান হয়, যার এক মাত্র কারণ জিয়াউর রহমানের একের পর এক সংবিধানের নানান আইন পরিবর্তন। ’৭২ সন থেকে রাজাকারদের অনেক অভিভাবকই বাংলাদেশের নানান অঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের সরাসরি কাজটি শুরু করে। খোন্দকার আব্দুল হামিদ যাদের অন্যতম।
দৈনিক আযাদ এবং ইত্তেফাকে মর্দে মোমিন ও স্পষ্টভাষীর ছদ্ম নামে লেখা এই লোকটি জিয়াউর রহমানের মধ্যে একজন পাকিস্তান প্রেমিককে আবিষ্কার করে সবার আগে। বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে নানান উষ্কানিমূলক লেখা লিখে জনগণকে ইসলামের সেন্টিমেন্ট দিয়ে উস্কিয়েছে । দুর্ভিক্ষ,জলপড়া বাসন্তী, মৃত্যু, অরাজকতা, লুটপাট, গণ-ধরপাকড়, সিরাজ শিকদার হত্যা নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে বিষাদ্গোর। স্পষ্টভাষীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু গোলাম আযমের সঙ্গে লন্ডনে তার মোলাকাত হয় ১৫ই আগষ্টের কিছু আগে। (দ্র: জীবনে যা দেখলাম। লেখক গোলাম আযম )। যুদ্ধ বিরোধী আন্তর্জাতিক লবিস্ট, ’৭১ পরবর্তী মুজিব সরকারের বিরুদ্ধে এই ঘোর মুসলিম লীগারের কলামগুলো ’৭২-’৭৫ পর্যন্ত জনমনে বিষ ছড়ায়। জিয়াউর রহমানকে সরাসরি অভ্যুত্থানের সাংকেতিক সুরসুড়ি তার কলামে। পরবর্তীতে দুই দুইবার তাকে মন্ত্রী বানায় জিয়াউর রহমান। সুতরাং যারা রাজাকারদের পিতা, তাদের বিচার কেন হবে না? না হলেও অন্তত পাঠ্যপুস্তকে এদের বিষয়ে জানান দেয়া রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। ’৭২-এ স্পষ্টভাষীকে গ্রেফতার করা হলেও অদৃশ্য আঙুলের নির্দেশে ছাড়া পেয়েই সাংবাদিকতা এবং পরোক্ষ রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে যা, প্রত্যক্ষ রাজনীতির চেয়েও বিপজ্জনক। আমাদের দেশে কোন কিছুই কেন কখনোই অসম্ভব নয়?
এর সাথে যুক্ত হয় সরকারবিরোধী হরেক রকম গোয়েবলসীয় মিথ্যা প্রচারনা, যেমনঃ
* বিদেশ থেকে প্রচুর সাহায্য আসছে, কিন্তু আওয়ামী লীগের লোকজন সব লুটেপুটে নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে
* শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল ব্যাংক ডাকাতি করে পালানোর সময় গুলিতে আহত হয়েছে
* আওয়ামী লীগের লোকজন দুর্নীতি ব্যাংক ডাকাতি করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলছে
* ত্রাণসাহায্যের বিশাল অংশ আওয়ামী লীগ ভারতে পাচার করে দিচ্ছে এবং নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে
* বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে ধংস করে দেয়ার জন্য রক্ষী বাহিনী বানানো হয়েছে, এ বাহিনীতে প্রচুর ভারতীয়কে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এবং বিপক্ষদের বিনা কারণে মেরে ফেলা হচ্ছে
* ভারত বিভক্তির সময় যে সকল হিন্দু ঘরবাড়ী ছেড়ে ভারতে চলে গিয়েছিল, তারা অচিরেই ফিরে আসবে এবং জমি জমা, বাড়ী ঘরের দখল নিয়ে নিবে
* বাকশালের মাধ্যমে দেশে গনতন্ত্রকে স্তব্ধ করে দিয়ে আওয়ামী লীগ একাই রাজত্ব চালাবে
এ সকল তথ্য অপরিণত অভিজ্ঞতাহীন তরুণদের দলে ভেড়ানো সন্ত্রাসবাদী ছদ্ম সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের মুখপাত্র “গণকন্ঠ”, দ্বিচারী ও জাতিবিদ্বেষী ভাসানী ন্যাপ এর মুখপাত্র “হক কথা”, বামপন্থী চৈনিকদের মুখপাত্র “হলিডে” এর মতো পত্রিকায় নিয়মিত ভাবে প্রচার করা হতো। কুখ্যাত সি.আই.এ. এজেন্ট ব্যারিষ্টার মইনুল হোসেনের ইত্তেফাকেও এধরনের মিথ্যা প্রোপাগান্ডামূলক খবর প্রচারিত হতো
এ সকল অপপ্রচারণার কারনে আওয়ামী লীগ তথা মুজিব ১৯৭০ সালে জনপ্রিয়তার যে উচ্চশিখরে উঠেছিলেন, সেই জনপ্রিয়তা ব্যাপক হ্রাস পায় । দেশের বহু মানুষ ঐসকল পত্রপত্রিকার মিথ্যে সংবাদ পড়ে বিভ্রান্ত হয়ে দেশের সকল দুর্গতির জন্য আওয়ামী লীগ দায়ী বলে ভাবতে থাকে। অনেকে এমনও ভাবতে শুরু করে যে -পাকিস্তানেই তারা ভাল ছিল। কেউ কেউ এমনও ভাবতে থাকে, মুজিব এবং ভারতই আমাদের পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিল, একত্রে থাকলে মুসলিম রাষ্ট্রটি অনেক শক্তিশালী হতে পারতো।
এদিকে আওয়ামী লীগের মধ্যে ঢুকে থাকা গাদ্দার খন্দকার মোশতাক, মাহবুবুল আলম চাষী, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, শাহ মোয়াজ্জেম চক্র সক্রিয় ছিল কোনোভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে আবারো একটা সম্পর্কে জড়ানো যায় কিনা সেটা নিয়ে। তাহেরউদ্দিন ঠাকুর(পেশাভিত্তিক ক্রমিক-১৩১, উপদেষ্টা সদস্য বহিঃ প্রচার বিভাগ, তথ্য মন্ত্রনালয়) এবং খন্দকার মোশতাকের বাড়ি ছিলো কুমিল্লায়। একই জেলার মানুষ সুবাদের তাদের মধ্যে চমৎকার ঘনিষ্ঠতা এবং সখ্য গড়ে ওঠে। মাহবুবুল আলম চাষী (ক্রমিক-৬৬৯) ছিলো চট্টগ্রামের মানুষ । এরা দুজনে ছিলেন খোন্দকার মোশতাকের ডান হাত। মানুষের আদালতে দন্ড এড়াতে পারলেও তিনি ইতিহাসের দন্ড এড়াতে পারেননি। মক্কায় হজ্জ্ব করতে যাওয়ার পথে তার গাড়িতে গ্যাস লিক হতে শুরু করে এবং দরজা-জানালা বন্ধ সেই গাড়ি থেকে যথাসময়ে বেরুতে না পেরে তার নির্মম মৃত্যু ঘটে। তার শরীর পুড়ে প্রায় ছাই হয়ে গিয়েছিল। তাহেরউদ্দিন ঠাকুর ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একসময়ের অন্যতম প্রিয় শিষ্য এবং তার বিশ্বাসভাজন মন্ত্রী। তিনি ষড়যন্ত্রে পেছন থেকে সক্রিয় ছিলেন, তলে তলে মোশতাকের গোপন বৈঠকে শরিক হতেন।
নামকরা সাংবাদিক আবেদ খান তাঁর ইতিহাদের কাছে আমার এ দায় শীর্ষক কলামে বলেছেন -
তখন বার্তা সম্পাদক মরহুম আসফউদ্দৌলা রেজা। আমার লেখার ওপর তাঁর এতখানি আস্থা ছিল যে তিনি স্ক্রিপ্ট দেখতে চাইতেন না। আমি বাসায় ফিরে ভাবছি একটা দারুণ চাঞ্চল্যকর ‘ওপেন সিক্রেট’ ছাপা হবে পরদিন। কিন্তু দেখলাম, পরদিন রিপোর্টটা ছাপা হয়নি। সেই মুহূর্তে আমার কাছে ‘ওপেন সিক্রেট’ সিরিজের চেয়ে পরিস্থিতিটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল।পাকিস্তান আমলে একসময় আমার চিফ রিপোর্টার ছিলেন তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। তিনি তখন বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রভাবশালী তথ্য প্রতিমন্ত্রী। গেলাম তাঁর কাছে, খুলে বললাম ঘটনার কথা, আশঙ্কার কথা। জানতাম, তাহের ঠাকুর বঙ্গবন্ধুর খুব বিশ্বস্ত। তাই চাইলাম, তিনি যেন বঙ্গবন্ধুকে খুলে বলেন সব কিছু। ১৫ আগস্টে বুঝেছিলাম, কী ভুল জায়গায় কথা বলেছি আমি। ওদিকে রেজা ভাইয়ের সঙ্গে খন্দকার মোশতাকের ছিল দারুণ খাতির। আর খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে ইত্তেফাকের সম্পর্কও ছিল অত্যন্ত নিবিড়।
৭৫’র মীর জাফর খন্দকার মোশতাক – তাহেরুদ্দিন ঠাকুর ও মাহবুবুল আলম গংয়ের পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র
কাজী আব্দুল হান্নান তাঁর সে রাতের হত্যাকাণ্ড শীর্ষক কলামে বলেন –
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এ সময় তার সেক্রেটারি ছিল পরবর্তীকালের অন্যতম ডাকসাইটে আমলা মাহবুব আলম চাষী। ১৯৭৪ সালে ভয়াবহ বন্যার পর বন্যা-উত্তর কর্মসূচিকে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বনির্ভর বাংলাদেশ কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করা হয়। এই কর্মসূচির পরিচালক করা হয় মাহবুব আলম চাষীকে। খন্দকার মোশতাক তাকে এই পদে নিয়াগের ব্যবস্থা করে। ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসের শেষদিকে কুমিল্লার বার্ডে এই কর্মসূচির চট্টগ্রাম বিভাগীয় সম্মেলন হয়। সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন খন্দকার মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, অধ্যাপক নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক খুরশিদ আলম, মাহবুব আলম চাষীসহ আরও অনেকে। নিজের চোখে দেখা এই ঘটনার সাক্ষ্য দিয়েছেন খুরশিদ আলম। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন বিকেলে একটি আর্মি জিপে সাদা পোশাকে মেজর আবদুর রশিদ এবং অপর এক সামরিক অফিসার রেস্ট হাউসে আসে এবং খন্দকার মোশতাকের কক্ষে প্রবেশ করে। মাহবুব আলম চাষী এ সময় তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে নিয়ে সেই কক্ষে যায়। সেখানে তারা ৩০ বা ৪০ মিনিট কথা বলার পর মাগরিবের আজানের আগে সেনা অফিসার দু’জন চলে যায়। পরে মে বা জুন মাসে মোশতাকের গ্রামের বাড়ির এলাকায় একটি ফুটবল টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলা শেষে মোশতাকের বাড়িতে চা-পানের সময় মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী কর্মসূচির সমালোচনা করতে থাকে। খন্দকার মোশতাককে সেদিন এসব নীতিনির্ধারণী কর্মসূচির বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক কটাক্ষ করতে দেখা যায়। সে বছর জুন-জুলাই মাসে দাউদকান্দি মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে পরিবার পরিকল্পনার এক সম্মেলন হয়। সম্মেলনে মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এবং বর্তমানের আলী আশরাফ এমপি উপস্থিত ছিলেন। পরে মাহবুব আলম চাষীও আসে। সম্মেলন চলাকালে আর্মির জিপে আসে মেজর আবদুর রশিদ, মেজর ফারুক, মেজর শাহরিয়ার এবং আরও কয়েকজন সেনা অফিসার। সম্মেলন শেষে মোশতাক, তাহেরউদ্দিন ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী, মেজর রশিদ, মেজর ফারুক এবং মেজর শাহরিয়ার মোশতাকের গ্রামের বাড়ি যায়। আসামিদের এই তৎপরতা ছিল গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ এবং এসব বৈঠকের আলোচনায় তারা হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করে। কাঙ্ক্ষিত প্রমোশন না পেয়ে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার আগে লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ১৯৭৩ সালে কুমিল্লায় ছিল। মেজর ডালিম, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা, মেজর আজিজ পাশা প্রথম ফিল্ড আর্টিলারিতে সেখানে কর্মরত থাকাকালে তাদের সঙ্গে শাহরিয়ারের ঘনিষ্ঠতা হয়। ওই সময়ে ঢাকার লেডিস ক্লাবে মেজর ডালিমের এক আত্মীয়ার বিয়েতে ডালিমের স্ত্রীসহ কয়েকজন লাঞ্ছিত হওয়ার একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীর ল্যান্সার ইউনিটের ও দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের কিছু অফিসার ও অন্যান্য র্যাঙ্কের কিছু সেনাসদস্য আওয়ামী লীগ নেতা গাজী গোলাম মোস্তফার বাড়ি আক্রমণ ও তছনছ করে। এ ঘটনার পর শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে ডালিম, নূর চৌধুরীসহ কয়েকজনের চাকরি যায়। শাহরিয়ার চাকরি ছাড়ার পর ঢাকায় পুরনো টিভি-ফ্রিজ মেরামতের ব্যবসা শুরু করে। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘শেরী এন্টারপ্রাইজ’ ছিল মেজর ডালিম, মেজর নূর চৌধুরী, আজিজ পাশা, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদার ওঠাবসার কেন্দ্র। সেখানে তারা আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও অন্য নেতৃবৃন্দের সমালোচনা করত। এ সময় দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ ভারতে প্রশিক্ষণ শেষ করে এর অধিনায়কের দায়িত্বে যোগদান করায় ডালিম একদিন তার সঙ্গে যোগাযোগ করে। পুরো ঘটনা তাকে জানিয়ে প্রতিকারের জন্য সে সাহায্য কামনা করলে রশিদ তাকে সাহায্যের আশ্বাস দেয়।
অপরদিকে প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সারের দায়িত্ব মেজর মোমিনের কাছে ছেড়ে দিতে হওয়ায় এবং তার অধীনে সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হওয়ায় সৈয়দ ফারুক রহমান ক্ষুব্ধ ছিল। ১৯৭৪ সালের শেষের দিকে অস্ত্র উদ্ধারের অভিযানে ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ ও নরসিংদীতে তার সঙ্গে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনায় সে আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর বীতশ্রদ্ধ ছিল। তার ওপর ডালিমের স্ত্রীকেন্দ্রিক ঘটনা-পাল্টা ঘটনায় ডালিম, নূরসহ কয়েকজনের চাকরিচ্যুতি ঘটে। তৎকালীন ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ জিয়াউর রহমানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ আলোচনা চলত। একদিন তিনি ফারুককে বলেছিলেন, দেশ বাঁচানোর জন্য একটা কিছু করা দরকার।
তখন গুরুত্ব না দিলেও ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের পর মেজর খন্দকার আবদুর রশিদের সঙ্গে দেশের অবস্থার পরিবর্তন সম্পর্কে পূর্ব আলোচনার সূত্রে তারা জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আলোচনা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে ভিত্তিতেই এপ্রিল মাসের এক রাতে ফারুক জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলাচনা করে পরামর্শ চায়। জবাবে তিনি বলেছিলেন, আমি কী করতে পারি, তোমরা করতে পারলে কিছু কর। বিষয়টি রশিদকে জানানোর পর পলিটিক্যাল বিষয়টি সে দেখবে বলেছিল। রশিদ পরে আত্মীয়তার সুবাদে খন্দকার মোশতাক এবং জিয়াউর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করে। মেজর খন্দকার রশিদ ঢাকায় আসার পর আর্টিলারির দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মহিউদ্দিনের সঙ্গে সুযোগ পেলেই রাজনৈতিক বিষয়ে কথা বলত। ১৯৭৫ সালের মে মাসের মাঝামাঝি একদিন রেজিমেন্ট লাইনে মহিউদ্দিনকে পেয়ে সে তার প্রাইভেট গাড়িতে তাকে হোটেল শেরাটনের পাশে রমনা পার্কের সামনের রাস্তায় নিয়ে যায়। সেখানে ডালিম ও নূর আসে। চারজন পার্কে গিয়ে ঝোপের আড়ালে কথাবার্তা বলে। ১৩ আগস্ট রাত ১০টা সাড়ে ১০টার দিকে ডালিম এবং নূর শাহরিয়ার রশিদের ক্যান্টনমেন্টের বাড়িতে যায়। শাহরিয়ারকে তারা খন্দকার আবদুর রশিদের বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে ডালিম ও রশিদের আলোচনাকালে রশিদ তাদের জানায়, ডোন্ট ওরি, ফারুকও সঙ্গে আছে। ১৪ আগস্ট বিকেলে খন্দকার আবদুর রশিদ ও নূর একটি কারে চড়ে শাহরিয়ারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে সঙ্গে নিয়ে খন্দকার মোশতাকের আগামসি লেনের বাড়িতে যায়। মোশতাককে পরদিন সকালে বাড়িতে থাকার বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়ে তারা ফিরে যায়। শেরাটনের কাছে নূর ও শাহরিয়ার গাড়ি থেকে নামে; কিন্তু কথা হয় রাতে আবার দেখা হবে। বিকেল ৪টার দিকে ডালিমকে বঙ্গবন্ধুর ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির আশপাশে ঘুরতে দেখা যায়। রাত প্রায় ১০টা নাগাদ ডালিম, আজিজ পাশা, বজলুল হুদা এবং নূর চৌধুরী ক্যান্টনমেন্টে শাহরিয়ার রশিদের বাসায় যায়। সেখানে ডালিম তাদের জানায়, সে চিফ অব জেনারেল স্টাফের কাছ থেকে আসছে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য আর্মি তলব করা হয়েছে। ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে আর্মি মুভ করবে। মুক্তিযোদ্ধা অফিসার হিসেবে সে তাদের সহযোগিতা চেয়েছে। এরপর সে মেজর রাশেদ চৌধুরীকে নিয়ে আসে। শাহরিয়ারের বাসায় খাওয়া-দাওয়ার পর তারা আলোচনায় বসে। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ডিউটিতে অংশ নেবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। সাব্যস্ত হয় মেজর রশিদের দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির টেকনিক্যাল হেডকোয়ার্টারে রাত ১টা থেকে দেড়টার মধ্যে তারা একত্রিত হবে। এই আর্টিলারিটি সে সময় নতুন বিমানবন্দর এলাকায় নাইট ট্রেনিংরত ছিল। এদিকে ১৪ আগস্ট বৃহস্পতিবার দুপুর ২টায় মেজর খন্দকার আবদুর রশিদ কমান্ডিং অফিসার হিসেবে তার অফিসে অফিসারদের ডেকে রাতে নাইট ট্রেনিং হবে বলে জানিয়ে দেয়। রেজিমেন্টের সব ব্যাটারি, ফার্স্ট লাইন আর্টিলারি, ফার্স্ট লাইন স্মল আর্মসসহ গোলাবারুদ সন্ধ্যার আগে নতুন এয়ারপোর্টের কাছে বালুরঘাটে যাবে এবং বাকি সব অফিসার ও ফোর্স ইউনিট লাইনে হাজির থেকে সন্ধ্যায় মার্চ করে টঙ্গী রোড ধরে এয়ারপোর্ট যাবে বলে সে নির্দেশ দেয়। প্রত্যেক অফিসার ও জওয়ানকে তাদের ব্যক্তিগত হাতিয়ার সঙ্গে নিতে বলা হয়। রাত ১০টা থেকে ১২টার মধ্যে একে একে দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসার ও জওয়ানরা এয়ারপোর্টের রানওয়েতে জড়ো হয়। রাত ২টায় তাদের পাঠানো হয় বালুরঘাট পজিশনে। সেখানে উপস্থিত সেনাসদস্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হয় সেনাবাহিনী বিদ্রোহ করেছে এবং দেশে সামরিক শাসন জারি হয়েছে। অপরদিকে পার্শ্ববর্তী ল্যান্সার হেডকোয়ার্টারে রাত ১টায় পেঁৗছায় ডালিম, রাশেদ চৌধুরী, হুদা, শাহরিয়ার, রশিদরা। সেখানে সমবেত এসব সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে ল্যান্সার ইউনিটের অস্ত্রাগার থেকে পোশাক ও অস্ত্র দেওয়া হয়। পশ্চিম পাশের খোলা জায়গায় ইউনিটের ট্যাঙ্কগুলো সারিবদ্ধ রাখা ছিল। ৩টায় সেখানে উপস্থিত হয় দ্বিতীয় ফিল্ড রেজিমেন্টের অফিসাররা। ম্যাপ হাঁটুতে রেখে ক্যাম্প টুলে বসে মেজর ফারুক এ সময় পাশে দাঁড়ানো মেজর খন্দকার আবদুর রশিদের সঙ্গে অপারেশনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে আলোচনা করে। ল্যান্সারের অন্যান্য অফিসার, জেসিও এবং এনসিও পর্যায়ের কর্মকর্তারাও সেখানে সমবেত ছিল। এ সময় মেজর মহিউদ্দিনের প্রশ্ন তোলায় পরিকল্পনার কথা ফাঁস করে ফারুক সবাইকে উত্তেজিত করতে একটি বক্তৃতা দেয়। একইসঙ্গে পরিকল্পনা অনুযায়ী উপস্থিত অফিসারদের দায়িত্ব ভাগ করে দেয়। সে বলে, শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বাসঘাতকতা করে দেশে বাকশাল কায়েম করেছেন। সেনাবাহিনীর পাল্টা রক্ষীবাহিনী গঠন করেছেন। চারটি বাদে সব খবরের কাগজ বন্ধ করে দিয়েছেন। গভর্নর নিয়োগ করেছেন। তিনি রাজতন্ত্র কায়েম করছেন। আমরা রাজতন্ত্র সমর্থন করতে পারি না। আর এসব করতে গিয়ে তিনি সেনাবাহিনীর বাজেট কমিয়ে দিয়েছেন। আর্মি বোধহয় থাকবে না। ডিসব্যান্ড হয়ে যাবে। বাংলাদেশে সরকার বদলানোর আর কোনো পথ নেই। চাবি একজন, শেখ মুজিব। তাকে দিয়ে ‘প্রক্লামেশন’ করিয়ে যদি ‘চেঞ্জ’ করা যায়। সে যদি রাজি না হয়, যদি ‘রেজিস্টান্স’ হয়, দেশ বাঁচবে না। আমরা কেউ ‘সার্ভাইভ’ করব না। কাজেই তাকে ‘এক্সিকিউট’ করা লাগবে। পলিটিক্যাল পরিবর্তন যেটা সেটা মেজর রশিদ ‘ডিল’ করবে। খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি করে রাষ্ট্র চালানো হবে।
অপারেশন পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে মেইন অপারেশনের দায়িত্ব মেজর ডালিমকে নিতে বলা হলে মাত্র কয়েকদিন আগে সেখানে সে কর্মরত ছিল বলে অসম্মতি জানায়। পরে দায়িত্ব দেওয়া হয় আর্টিলারির মেজর মহিউদ্দিনকে। বঙ্গবন্ধু যাতে পালাতে না পারেন বা বাইরে থেকে তাকে কেউ উদ্ধার করতে না পারেন, তাই পুরো এলাকা সিল করে দিয়ে সরাসরি কথা বলে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসতে বলা হয়। কিন্তু বাধা এলে বা আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণ হলে নিচে এনে ‘এক্সিকিউট’ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। তাদের সাপোর্ট দিতে আর্টিলারি ট্যাঙ্ক রাখা হয়। রক্ষীবাহিনী বা অপর কোনো পাল্টা আক্রমণ প্রতিহত করতে ফিল্ড রেজিমেন্টকে বিভিন্ন কৌশলগত অবস্থানে মোতায়েন করা হয়। এ সময় ডালিম জানায়, প্রেসিডেন্টের বাড়িতে প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট থেকে গার্ড রয়েছে। তারা মহিউদ্দিনকে বাধা দিতে পারে। বজলুল হুদা এর আগে প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্ট ছিল বলে সে তাদের ম্যানেজ করতে পারবে ভেবে হুদা, নূর চৌধুরী এবং মেজর মহিউদ্দিনকে একসঙ্গে মূল অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মেজর রশিদ দায়িত্ব নেয় জেনারেল জিয়া ও খন্দকার মোশতাক আহমদসহ অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের। ফারুকের দায়িত্বে থাকে ট্যাঙ্ক। রাশেদ চৌধুরী ও শাহরিয়াররা থাকে ডালিমের সঙ্গে। তাদের বলা হয় ডালিম যাবে রেডিও বাংলাদেশে, মেজর শাহরিয়ার, মেজর রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মোস্তফা এবং ক্যাপ্টেন মাজেদ মিন্টো রোডে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে ফোর্স মোতায়েন করবে। সেখানে কাজ শেষ করে শাহরিয়ার রেডিও বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে ক্যাপ্টেন মোস্তফাকে আগামসি লেনে খন্দকার মোশতাকের বাড়ি পাহারায় এবেং রিসালদার মোসলেম উদ্দিনকে একজন অফিসারসহ শেখ মণির বাড়িতে পাঠাতে ফারুক নির্দেশ দেয়। মেজর আজিজ পাশাকে পিলখানার বিডিআরদের নড়াচড়া দেখলে সেদিকে অগ্রসর হওয়ার দায়িত্ব দিয়ে ফারুক নিজে অবশিষ্ট ট্যাঙ্ক রেজিমেন্ট ও সৈন্যদের নিয়ে রক্ষীবাহিনী সামলে দেবে বলে ঘোষণা করে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ভোর ৪টায় তাদের যাত্রা শুরু হয়।
নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী চার সাক্ষীর বর্ণনায় ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড
মামলায় বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নারকীয় হত্যাকাণ্ডের প্রত্যক্ষদর্শী চার সাক্ষীর বর্ণনা থেকে সেদিনের চিত্র বেরিয়ে এসেছে। তাদের বর্ণনা অনুযায়ী ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুক্রবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে তার পিএ মুহিতুল ইসলামকে বলেন,
সেরনিয়াবাতের বাড়িতে দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে লাগা
কিন্তু চেষ্টা করেও লাইন না পেলে বঙ্গবন্ধু নিজেই দোতলা থেকে নিচে পিএ মুহিতুলের অফিস কক্ষে নেমে আসেন। পুলিশ কন্ট্রোল রুম না পেয়ে তিনি সেখান থেকে গণভবন এক্সচেঞ্জে নিজেই রিসিভার নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন। পৌনে ৫টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দক্ষিণ দিক থেকে লাগাতার গুলি আসতে থাকে। বঙ্গবন্ধু টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন। কিছু সময় পর গুলি বন্ধ হলে কাজের ছেলে সেলিম ওরফে আবদুল দোতলা থেকে বঙ্গবন্ধুর চশমা ও পাঞ্জাবি নিয়ে আসে। সেখানে দাঁড়িয়েই সেগুলো পরে তিনি বারান্দায় গিয়ে বলেন, ‘এত আর্মি পুলিশ সেন্ট্রি, এত গুলি হলো তোমরা কী কর’ বলে তিনি দোতলায় চলে যান। শেখ কামাল ওপর থেকে নেমে বাড়ির আর্মি ও পুলিশদের তার সঙ্গে আসতে বলে বারান্দায় এগিয়ে যান। কিন্তু গুলি বন্ধ হওয়ার পর কালো ও খাকি পোশাক পরা কিছু সৈনিক হ্যান্ডস আপ হ্যান্ডস আপ বলতে বলতে দৌড়ে আসে। তারা গেট দিয়ে বাড়িতে ঢুকে পড়ে। তাদের মধ্য থেকে বজলুল হুদা বারান্দায় দাঁড়ানো শেখ কামালের পায়ে গুলি করে। তিনি এ সময় ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল’ বলার সঙ্গে সঙ্গে তাকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করা হয়। একটি গুলি বাড়িতে কর্তব্যরত ডিএসপি নজরুল ইসলামের গায়ে লাগে। বজলুল হুদা ও নূর বাড়ির কাজের লোক এবং পুলিশদের গেটের সামনে লাইন করে দাঁড় করায়। সেখানে একজন এসবি অফিসারকে একজন আর্মি গুলি করে মারে। ল্যান্সার মেজর মহিউদ্দিন গুলি করতে করতে ফোর্স নিয়ে দোতলায় উঠে যায়। বঙ্গবন্ধুকে এ সময় তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে তারা তাকে ঘিরে ফেলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যায়। একই সময় বজলুল হুদা ও মেজর নূর কয়েকজন ফোর্স নিয়ে মামলার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী বাড়ির গার্ড বাহিনীর হাবিলদার কুদ্দুস শিকদারকে তাদের সঙ্গে আসার নির্দেশ দিয়ে দোতলায় উঠছিল। সিঁড়ি দিয়ে দু’এক ধাপ নামার মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু তাকে ঘিরে রাখা আর্মিদের উদ্দেশে বলেন, ‘তোরা কী চাস, কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’ নিচের দিক থেকে ওপরে উঠে আসার মাঝের র্যান্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে মেজর নূর ইংরেজিতে কিছু একটা বলে। মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের ফোর্সরা একপাশে সরে যায়। বঙ্গবন্ধু আবারও প্রশ্ন করেন, ‘তোরা কী চাস’? সঙ্গে সঙ্গে হুদা তার পাশের কারও কাছ থেকে একটি স্টেনগান নিয়ে এবং নূর তার হাতের স্টেনগান দিয়ে একসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। সিঁড়িতেই লুটিয়ে পড়েন জাতির জনক। তখন তার পরনে ছিল লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবি, এক হাতে সিগারেটের পাইপ, অন্য হাতে দিয়াশলাই। এরপর মেজর মহিউদ্দিন, মেজর নূর, মেজর বজলুল হুদাসহ সবাই নেমে দক্ষিণ দিকের গেট দিয়ে বাইরের রাস্তায় চলে যায়। কিন্তু এর পরপরই মেজর আজিজ পাশা, রিসালদার মোসলেম উদ্দিন ল্যান্সারের ও দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারির সৈন্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে প্রবেশ করে। আজিজ পাশা বঙ্গবন্ধুর কক্ষের দরজা খুলতে বলে, কিন্তু ভেতর থেকে না খোলায় দরজায় গুলি করা হয়। বেগম মুজিব দরজা খুলে কক্ষে থাকা পরিবারের অন্যদের না মারার জন্য কাকুতি-মিনতি করেন। কিন্তু একদল ফোর্স বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও মামলার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী বাড়ির চাকর রমাকে রুম থেকে বের করে নিয়ে আসে। বেগম মুজিব সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মারলে সেখানেই মারতে বলে তিনি আর অগ্রসর হতে না চাওয়ায় অন্যদের নিচে নেওয়া হলেও তাকে আবার রুমে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। আজিজ পাশা সেখানে রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের হাতের স্টেনগান নিয়ে রুমের সবাইকে গুলি করে। সেখানে ছিলেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ জামালের স্ত্রী রোজি এবং শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা।
দোতলা থেকে নামিয়ে শেখ নাসের ও রাসেলকে অন্যদের সঙ্গে লাইনে দাঁড় করানো হয়। এ সময় নাসের বলেন, ‘স্যার আমি তো রাজনীতি করি না, কোনোরকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে খাই।’ পাহারারত একজন আর্মি অপর একজনকে এর জবাবে বলে, শেখ মুজিব ‘বেটার দ্যান’ শেখ নাসের। ঠিক আছে, আপনি ওই রুমে গিয়ে বসেন, বলে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রিসিপশন রুমে এবং রুমের বাথরুমে নিয়ে তাকে গুলি করা হয়। শেখ নাসের পানি পানি বলে চিৎকার করতে থাকলে গুলি করে ফিরে আসা আর্মিটি অপর একজনকে বলে, পানি দিয়ে আয়। দ্বিতীয়জন গিয়ে তাকে আবারও গুলি করে।
মামলার বাদী মুহিতুল ইসলামকে জড়িয়ে ধরে ভয়ার্ত শিশু শেখ রাসেল লাইনে দাঁড়িয়ে বলেছিল_ ‘ভাইয়া আমাকে মারবে না তো?’ মায়ের কাছে যাওয়ার জন্য কান্নাকাটি করছিল রাসেল। শিশু রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য ল্যান্সারের একজন হাবিলদারকে হুকুম দেয় আজিজ পাশা। তাকে দোতলায় নিয়ে মায়ের লাশের কাছে মাথায় গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘাতক আর্মিটি ফিরে এসে পাশাকে জানায়, স্যার সব শেষ। এর কিছু সময় পর একটা ট্যাঙ্কে মেজর ফারুক বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটে আসে। সেখানে আজিজ পাশা, নূর চৌধুরী, মহিউদ্দিন ও বজলুল হুদা তার সঙ্গে কথা বলে। ফারুক ট্যাঙ্ক নিয়ে ফিরে যাওয়ার পরপর একটি লাল কারে করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আনা হয় কর্নেল জামিলের লাশ।
আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে হত্যাযজ্ঞ শেষ করে শাহরিয়ার এসে ডালিমের সঙ্গে রেডিও স্টেশনে যোগ দেয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর ঘোষণা দিতে থাকে ডালিম। রেডিও স্টেশনের সার্বিক দায়িত্বে থাকে শাহরিয়ার। সেখানে আনা হয় মোশতাককে। আসে তাহেরউদ্দিন ঠাকুর। তিন বাহিনীর তিন প্রধানকে হাজির করে আনুগত্যের ঘোষণা দেওয়া হয়। তাহের ঠাকুর রাষ্ট্রপতি হিসেবে মোশতাকের ভাষণ তৈরি করে রেকর্ড করায়। ষড়যন্ত্রের বিভিন্ন পর্যায়ে যারা ছিল পৃথক তারা সবাই একত্রিত হয় বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি ও নতুন মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠানে। সেখানে সর্বেসর্বা ছিল ঘাতককুলের শিরোমণি সেনা অফিসাররা। যাদের কিছুসংখ্যককে পরবর্তী সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে আত্তীকরণ করা হয়। এরা হলো তৎকালীন মেজর শরিফুল হক ডালিম, মেজর আবদুল আজিজ পাশা, মেজর একেএম মহিউদ্দিন আহাম্মদ, মেজর বজলুল হুদা, লে. ক. এএম রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম, আবদুল মাজেদ, ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন আনসার, লে. ক. সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, লে. ক. এসএইচ নূর চৌধুরী এবং মেজর আহম্মদ শারফুল হোসেন। তৎকালীন চিফ অব আর্মি স্টাফের অনুরোধে তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আত্তীকরণ করে বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে রাখা হয়েছিল।
হাবিলদার (অব.) কুদ্দুস সিকদার বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের চার নম্বর সাক্ষী। ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে তাঁর দেওয়া সাক্ষ্য ১৯৯৭ সালের ২৮ জুলাই গৃহীত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি তত্কালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বর বাড়িতে কর্তব্যরত ছিলেন। তাঁর জবানবন্দি নিচে তুলে ধরা হলো:
আমার নাম: হাবিলদার (অব.) মো. কুদ্দুস সিকদার
আমার পিতার নাম: গোলাম মুক্তার সিকদার
গ্রাম-পবলবেগ, পুলিশ স্টেশন-আলফাডাঙ্গা, জেলা-ফরিদপুর
বর্তমান ঠিকানা-বাড়ি নং-৩, বাইশ টেকী, ১৩নং সেকশন, মিরপুর, ঢাকা।
যথাসময়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আমরা পৌঁছাইয়া আমি ও আমার সঙ্গীয় গার্ডরা বিউগলের সুরে সুরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করিতে থাকি। এই সময় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দক্ষিণে লেকের দিক হইতে লাগাতার গুলি আসিতে থাকে। তখন আমি এবং আমার গার্ডসহ দেওয়ালের আড়ালে লাইন পজিশনে যাই। গুলি বন্ধ হওয়ার পর পাল্টা গুলি করার জন্য আমার পূর্ববর্তী গার্ড কমান্ডারের নিকট গুলি খোঁজাখুঁজি করিতে থাকি। এই সময় কালো ও খাকি পোশাকধারী সৈনিক হ্যান্ডস আপ বলিতে বলিতে গেটের মধ্য দিয়া বাড়িতে ঢোকে। তখন ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা, মেজর নূর ও মেজর মহিউদ্দিনকে (ল্যান্সারের) গেইটে দেখি। তারপর ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর বঙ্গবন্ধুর বাড়ির বারান্দায় আসিয়া সেখানে কামালকে দাঁড়ানো দেখিয়াই ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা হাতের স্টেনগান দ্বারা শেখ কামালকে গুলি করে। শেখ কামাল গুলি খাইয়া রিসিপশন রুমে পড়িয়া যায়। ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা পুনরায় শেখ কামালকে গুলি করিয়া হত্যা করে। ইহার পর ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর বাড়ির পুলিশের ও কাজের লোকদের গেটের সামনে লাইনে দাঁড় করায়। ইহার পর মেজর মহিউদ্দিন তাহার ল্যান্সারের ফোর্স লইয়া গুলি করিতে করিতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দোতলার দিকে যায়। তারপর ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর কয়েকজন ফোর্স লইয়া বাড়ির বারেন্দা দিয়া দোতলার দিকে যায়। এই সময় আমাদেরকেও তাহাদের সাথে যাইতে হুকুম দিলে আমি তাহাদের পিছনে পিছনে যাই। ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূর সিঁড়ি দিয়া চৌকির (Slap) উপরে গেলে মেজর মুহিউদ্দিন ও তাহার সঙ্গীয় ফোর্স বঙ্গবন্ধুকে নিচের দিকে নামাইয়া আনিতে দেখি। আমি ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও মেজর নূরের পিছনে দাঁড়ানো ছিলাম। এই সময় মেজর নূর ইংরেজিতে কি যেন বলিলেন। তখন মুহিউদ্দিন ও তাহার ফোর্স এক পাশে চলিয়া যায়। এই সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন ‘তোরা কি চাস’ । এর পরই ক্যাপ্টেন হুদা ও মেজর নূর হাতের স্টেনগান দ্বারা বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে। সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু সিঁড়ির মধ্যে পড়িয়া মৃত্যুবরণ করেন। তখন বঙ্গবন্ধুর পরনে একটা লুঙ্গি, গায়ে পাঞ্জাবি, একহাতে সিগারেটের পাইপ, অন্য হাতে দিয়াশলাই ছিল। অতঃপর মেজর মুহিউদ্দিন, মেজর নূর, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদাসহ সবাই নিচে নামিয়া আসিয়া দক্ষিণ দিকে গেটের বাহিরে রাস্তায় চলিয়া যায়। কিছুক্ষণ পর মেজর আজিজ পাশা, রিসালদার মোসলেউদ্দিন ও ল্যান্সারের ফোর্স এবং টু-ফিল্ড আর্টিলারির ফোর্স গেটের সামনে আসে। তার পর মেজর আজিজ পাশা তাহার ফোর্স লইয়া গেটের মধ্যে দিয়া বাড়ির দোতলার দিকে যাইতে থাকে। আমিও তাহাদের পিছনে পিছনে যাই। সিঁড়ি দিয়া দোতলায় যাইবার পর দোতলায় সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদারকে দেখি। তারপর মেজর আজিজ পাশা তার ফোর্সসহ দোতলায় বঙ্গবন্ধুর রুমের দরজা খোলার জন্য বলে। দরজা না খুলিলে দরজায় গুলি করে। তখন বেগম মুজিব দরজা খুলিয়া দেয়। দরজা খুলিয়া বেগম মুজিব রুমের ভিতরে থাকা লোকদের না মারার জন্য কাকুতিমিনতি করেন। কিন্তু তাহার কথা না রাখিয়া একদল ফোর্স রুম হইতে বেগম মুজিব, শেখ রাসেল, শেখ নাসের ও একজন বাড়ির চাকরকে রুম হইতে বাহির করিয়া নিয়া আসে। বেগম মুজিব সিঁড়ির নিকট আসিয়া শেখ মুজিবের লাশ দেখিয়া কান্নায় ভাঙ্গিয়া পড়েন। এরপর বেগম মুজিবকে পুনরায় বঙ্গবন্ধুর বেড রুমে নিয়া যায়। অতঃপর শেখ নাসের, শেখ রাসেল ও চাকরকে নিচে নামাইয়া নিয়া যায়। মেজর আজিজ পাশা, রিসালদার মুসলেমুদ্দিন হাতের স্টেনগান দ্বারা বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে থাকা সবাইকে গুলি করে। সেখানে বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ জামালের ও শেখ কামালের স্ত্রী ছিল। তাহারা গুলি খাইয়া মৃত্যুবরণ করেন। তাহার পর তাহারা নিচে চলিয়া আসে। আমিও তাহাদের পিছনে চলিয়া আসিয়া রিসিপশনের বাথরুমের মধ্যে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শেখ নাসেরের লাশ দেখি। এরপর গেটের সামনে লাইনে সাদা পোশাক পরিহিত একজন পুলিশের লাশ দেখি। তারপর মেজর আজিজ পাশা গেটের বাহিরে গিয়া ওয়্যারলেসে কথাবার্তা বলে। কথা বলিয়া গেটের সামনে আসে। তখন শেখ রাসেল তাহার মায়ের কাছে যাইবে বলিয়া কান্নাকাটি করিতেছিল। মেজর আজিজ পাশা ল্যান্সারের একজন হাবিলদারকে হুকুম দিলেন, “শেখ রাসেলকে তাহার মায়ের কাছে নিয়া যাও।” ঐ হাবিলদার শেখ রাসেলের হাত ধরিয়া দোতলায় নিয়া যায়। কিছুক্ষণ পর দোতলায় গুলির আওয়াজ ও কান্নাকাটির চিত্কার শুনিতে পাই। তারপর ঐ হাবিলদার নিচে গেটের কাছে আসিয়া মেজর আজিজ পাশাকে (বলে),‘ স্যার সব শেষ!’ এরপর গেটের সামনে একটা ট্যাংক আসে। মেজর ফারুক সাহেব ঐ ট্যাংক হইতে নামিলে মেজর আজিজ পাশা, মেজর নূর, মেজর মহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা তাহার সহিত কথাবার্তা বলেন। তারপর মেজর ফারুক ট্যাংক নিয়া চলিয়া যান। কিছুক্ষণ পর একটা লাল কারে করিয়া কর্নেল জামিলের লাশ বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভেতর নিয়া যায়। একই সময় দোতলায় কিছু ভাঙ্গাচুরার শব্দ শুনিতে পাই। তখন বাড়ির উত্তর পাশের সিঁড়ি দিয়া দোতলায় উঠিয়া বঙ্গবন্ধুর বেড রুমে যাই। সেখানে বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ জামালের স্ত্রী এবং শেখ কামালের স্ত্রীর লাশ রক্তাক্ত অবস্থায় দেখি। একই রুমে শেখ রাসেলের চোখ ও মাথার মগজ বাহির হওয়া অবস্থায় তাহার লাশ দেখি। তখন রুমের মধ্যে ফোর্সদের মালামাল তছনছ করিতে দেখি এবং মূল্যবান মালামাল তাহাদের কাঁধের ব্যাগে ঢুকাইতে দেখি।
একই সময় সুবেদার আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদার সাহেবকে রুমের ভিতর আলমারি হইতে একটি ব্রিফকেস বাহির করিয়া উহাতে কিছু স্বর্ণালংকার ও কিছু বিদেশি মুদ্রা ঢুকাইতে দেখি। রুমের ভিতর থাকা ফোর্স একটা ব্রিফকেস, একটা রেডিও, একটা টেলিভিশন নিয়া নিচে নামিয়া রাস্তার ধারে একটা জিপ গাড়িতে রাখে।
কিছুক্ষণ পর মেজর ফারুক সাহেব ও মেজর শরিফুল হক ডালিম সাহেব গেটের সামনে আসে। তখন মেজর নূর, মেজর আজিজ পাশা, মেজর মুহিউদ্দিন, ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদারও গেটের সামনে উপস্থিত ছিলেন। মেজর ফারুক সাহেব এখন কাঠগড়ায় আছেন (সঠিকভাবে শনাক্ত)। মেজর ফারুক সাহেব ক্যাপ্টেন বজলুল হুদা ও সুবেদার মেজর আবদুল ওহাব সাহেবকে কাছে ডাকেন। (কাছে ডাকিয়া মেজর ফারুক সাহেব ক্যাপ্টেন বজলুল হুদার কাঁধে স্টার খুলিয়া সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব সাহেবের হাতে দেন। এরপর মেজর ফারুক সাহেব সুবেদার মেজর জোয়ারদারের কাঁধের শাপলা খুলিয়া কাঁধে পরাইয়া দেন। ইহার পর মেজর ফারুক সাহেব তাহাকে মেজর হুদা বলিয়া সম্বোধন করিলেন। ইহার পর মেজর ফারুক সাহেব সুবেদার মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদার সাহেবের কাঁধে স্টার লাগাইয়া তাহাকে লেফটেন্যান্ট ডাকিলেন। তারপর সেখান হইতে সব অফিসার চলিয়া যায়।)
যাওয়ার সময় মেজর হুদা আমাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে পড়ে থাকা লাশ রক্ষণাবেক্ষণসহ গোটা বাড়ির দায়িত্ব দিয়া যান। আমিসহ ৮ জন ঐ বাড়িতে ডিউটিতে থাকি। জুমার নামাজের পূর্বে ক্যাপ্টেন আবুল বাশার সাহেবকে গেটের সামনে দেখি। ঐ দিন গিয়া রাত্রে মেজর হুদাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে দেখি। তিনি আমাকে মোহাম্মদপুর শের শাহ রোডের একটি কাঠের আড়তে নিয়া যায়। সেখানে মেজর বজলুল হুদা কাঠের দোকানদারকে ১০টি লাশের কাঠের বাক্স বানাইয়া দিবার জন্য বলে এবং বাক্সগুলি বঙ্গবন্ধুর ৩২নং রোডস্থ বাড়িতে পৌঁছাইয়া দিতে বলে। সেখান হইতে মেজর বজলুল হুদা আমাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নামাইয়া দিয়া চলিয়া যান। ১৫ই আগস্ট দিবাগত শেষ রাত্রে কাঠের আড়তদার ঠেলা গাড়িতে করিয়া লাশের জন্য ১০টি কাঠের বাক্স নিয়া আসে। ফজরের আজানের পরে মেজর বজলুল হুদা আর্মির Supply transport company-র ফোর্সসহ একটি গাড়িতে করিয়া বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসে। মেজর বজলুল হুদা, বঙ্গবন্ধুর লাশ বাদে বাকি লাশগুলি (৯টি) ঐ গাড়িতে করিয়া নিয়া যায়। ১৬ই আগস্ট সকাল অনুমান ৯/১০টার দিকে একটি পিকআপে করিয়া মেজর বজলুল হুদা সাহেব বঙ্গবন্ধুর লাশ বিমানবন্দরে নিয়া যায়। ইহার পর একজন জেসিও এবং ৮/১০ জন সৈনিক বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আসে। তাহারা বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দরজা জানালা বন্ধ করিয়া তালা লাগায়। ইহার পর তাহারা চলিয়া যায়। ১৭ই আগস্ট অনুমান সকাল ১০টার সময় আমাদের বদলি গার্ড আসে। আমি তাহাদিগকে চার্জ বুঝাইয়া দিয়া আমার সঙ্গীয় গার্ড লইয়া গণভবনে চলিয়া যাই। পরের দিন অর্থাত্ ১৮ই আগস্ট দিবাগত রাতে ঢাকা হইতে ওয়ান ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টে যোগদানের জন্য ক্যাপ্টেন আবুল বাশারসহ পুরা গার্ড কুমিল্লা চলিয়া যাই।
মেজর বজলুল হুদা যে ৯টি লাশ নেয় তন্মধ্যে কর্নেল জামিল, শেখ নাসের, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী সুলতানা, শেখ জামালের স্ত্রী রোজী, বেগম মুজিবের লাশ ও একজন পুলিশ অফিসারের লাশ ছিল।
আর্মিতে ৯টা কোর আছে। আমি আর্টিলারি কোরে ছিলাম। আরমারি কোর নামেও একটি কোর আছে। তাহাদের কালো ওভার আল কমবিনেশনের পোশাক ছিল। আর্টিলারিদের খাকি পোশাক ছিল। আরমার অথবা ল্যান্সার একই কোর।
সুবেদার মেজর ওয়াহাব জোয়ারদার সাহেব আমার অফিসার ছিলেন। তাহাকে আমি চিনি। তিনি এখন কাঠগড়ায় আছেন (সঠিকভাবে শনাক্ত)। লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় সেলিমের হাতে এবং পেটে দুইটি গুলির জখম দেখিলাম। ইহার পর দেখিলাম কালো পোশাক পরিহিত আর্মিরা আমাদের বাসার সব জিনিসপত্র লুট করিয়া নিয়া যাইতেছে। তখন ডিএসপি নুরুল ইসলাম এবং পিএ/রিসেপশনিস্ট মুহিতুল ইসলামকে আহত দেখি। এরপর আমাদের বাসার সামনে একটা ট্যাংক আসে। ট্যাংক হইতে কয়েকজন আর্মি নামিয়া ভিতরের আর্মিদের লক্ষ করিয়া জিজ্ঞাসা করে ভিতরে কে আছে । উত্তরে ভিতরের আর্মিরা বলে ‘All are Finished’। অনুমান ১২টার দিকে আমাকে ছাড়িয়া দিবার পর আমি প্রাণভয়ে আমার গ্রামের বাড়ি টুঙ্গীপাড়া চলিয়া যাই। আমি তদন্তকারী অফিসারের কাছে জবানবন্দি করিয়াছি।
(বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পেপারবুক থেকে সংগৃহীত)
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনসহ তিনটি বাড়িতে সংঘটিত খুনিদের এমন নারকীয় পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের এমন ভয়াল বীভৎসতার হৃদয় স্পর্শী বর্ণনা দিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর তৎকালীন মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ পিএসসি। তার বর্ণনায় তিনি ব্যক্ত করেন এইভাবে-
কী বীভৎসতা! রক্ত, মগজ ও হাড়ের গুঁড়ো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল প্রতিটি তলার দেয়াল, জানালার কাচ, মেঝে ও ছাদে। রীতিমতো রক্তগঙ্গা বইছে যেন ওই বাড়িতে। গুলির আঘাতে দেয়ালগুলোও ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। চারপাশে রক্তের সাগরের মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ঘরের জিনিসপত্র। প্রথম তলার সিঁড়ির মাঝখানে নিথর পড়ে আছেন ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া চেক লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা স্বাধীনতার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু লাশ। তলপেট ও বুক ছিল বুলেটে ঝাঁঝরা। নিথর দেহের পাশেই তাঁর ভাঙ্গা চশমা ও অতিপ্রিয় তামাকের পাইপটি। অভ্যর্থনা কৰে শেখ কামাল, টেলিফোন অপারেটর, মূল বেডরুমের সামনে বেগম মুজিব, বেডরুমে সুলতানা কামাল, শেখ জামাল, রোজী জামাল, নিচতলার সিঁড়ি সংলগ্ন বাথরুমে শেখ নাসের এবং মূল বেডরুমে দুই ভাবির ঠিক মাঝখানে বুলেটে ক্ষত-বিক্ষত রক্তাক্ত অবস্থায় পড়েছিল ছোট্ট শিশু শেখ রাসেলের লাশ।
নৃশংসভাবে নিহত ১৮ জনের লাশ তিনটি বাড়ি ও হাসপাতালের মর্গ থেকে সংগ্রহ করে সেগুলো দাফন করার এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্কালীন মেজর আলাউদ্দিন আহমেদ পিএসসি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তত্কালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর ঘটনাস্থল ধানমন্ডির বাড়িসহ আরও দুটি বাড়িতে গিয়েছিলেন তিনি। আগ্নেয়াস্ত্রের বুলেটে ক্ষতবিক্ষত লাশ এবং সেগুলো দাফন করার দায়িত্ব পালন করে সে সময়ের ঢাকা সেনানিবাসের স্টেশন হেডকোয়ার্টারে কর্মরত স্টাফ অফিসার আলাউদ্দিন আহমেদ একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছিলেন নিজের দপ্তরে। এ ঘটনায় আবেগতাড়িত হয়ে পরে ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একটি কবিতাও লিখেছিলেন তিনি। কবিতাটির শিরোনাম ছিল ‘একটি কালো রাত’।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের বিয়োগান্তক ঘটনা সম্পর্কে মেজর আলাউদ্দিনের একটি স্মৃতিচারণা এর আগে একটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম আলো এবার সংগ্রহ করেছে তাঁর আনুষ্ঠানিক প্রতিবেদনটি। হূদয়স্পর্শী ভাষায় ইংরেজিতে লিখিত সেই প্রতিবেদনের বাংলা অনুবাদ এখানে প্রকাশিত হলো:
No comments:
Post a Comment